বাঙালির নববর্ষ মানেই খাওয়াদাওয়া। দেখবেন কাগজ-টাগজে কেবল পেটপুজোর খবর এই দিনে! এখন ভয়ানক প্রাচীন কালে, মানে ধরুন সিন্ধু সভ্যতা বা বেদের কালে আমরা কি খেতাম?
মানুষ যখন শুধু শিকার ছেড়ে অন্য কিছু খাওয়া ধরলো, তখন মূলত দুই ধরণের শস্য তার পেট ভরাতো, cereals ও pulses, দানাশস্য এবং ডালশস্য!
সিন্ধু সভ্যতার যুগে মানুষ মূলত বার্লি খেতো ! কিন্তু গম ও খেতো, এবং রুটি জাতীয় খাবার ও বানানো হত! বেদের সময়েও বাৰ্লিই প্রধান খাদ্যশস্য ছিল !
কিন্তু এসব উত্তর পশ্চিম ভারতের দিকে, পূর্ব ভারতে ধান চাষের সমস্যা ছিল না, তাই সেটাই মূল খাদ্য ছিল, তেমনই দক্ষিণ ভারতে মিলেট জাতীয় শস্য চাষ হতো, সুতরাং সেটাই মূল খাবার ছিল, যদিও ভাত ও খাওয়া হতো!
রান্না কিসে হত? প্রথম দিকে দুধ থেকে তৈরী মাখনে, তিল থেকেই সবচেয়ে প্রথমে তেল তৈরী করা হয়, পরবর্তী কালে সর্ষে থেকেও।
মশলা? আদা, হলুদ, তেঁতুল, গোলমরিচ, কারিপাতা, পিপুল, এলাচ এমনকি তুলসীও ব্যবহৃত হতো অনেক প্রাচীন কাল থেকে। জিরে,হিং,সর্ষে, দারচিনি এসবের ব্যবহারও অনেক প্রাচীন, তবে এগুলো এসেছিলো পশ্চিম এশিয়া থেকে।
মিষ্টি? চিনির ব্যবহার ছিল না আদি কালে। মধু, খেজুর, তালের গুড়, এবং নানারকম মিষ্টি ফলই মূলত ব্যবহার হতো !
দই, ঘি, ঘোলের ব্যবহার ছিল, যদিও দুধের গুরুত্ত্বপূর্ন উৎস ছিল মোষ!
আর হ্যাঁ মাছ এবং ছাগল ভেড়ার মাংস খাওয়ার চল ছিল, চালে মাংস মিশিয়ে পলান্ন তৈরী হতো।
নানা ধরণের খাদ্য তৈরির চলও অনেক প্রাচীন, সব থেকে প্রাচীন সম্ভবত চালে ডাল মিশিয়ে খিচুড়ি এবং দুধে চাল মিশিয়ে পায়েস! ঋগ্বেদে অনেকবার অপূবা বলে খাদ্যের উল্লেখ আছে, যা বার্লি বেটে, মধু মিশিয়ে ঘি'তে ভেজে তৈরী করা হতো, এটাই সম্ভবত দক্ষিণ ভারতের আপ্পাম এবং আমাদের মালপোয়ার পূর্বজ।
তবে প্রাচীন ভারতে নববর্ষের গুরুত্ত্ব কত ছিল বলা যায় না! বরং বসন্ত উৎসবের প্রচুর বর্ণনা আছে, আর তাতে খাবার দাবারের সঙ্গে মাধ্বী, গৌড়ীয়, তাড়ি, কিলালা এবং বড়লোকদের জন্যে মদিরার উল্লেখও কম নেই !
যাইহোক। আমাদের খাবারদাবারের মূল জিনিসগুলো এখনো প্রায় একই আছে, সুতরাং পেটপুরে খান এবং নববর্ষের শুভেচ্ছা নিন!
কার্তিক মাসের এই হিমঝরা সন্ধ্যেতে নাকি আসেন আমাদের পূর্বজরা। আকাশপ্রদীপের আলোতে, চৌদ্দ প্রদীপের মৃদু আলোআঁধারিতে....অথবা তারা হয়ত আগেই এসে গেছেন, আমরা খবর রাখি না। কে জানে।
কার্তিক মাসের এই হিমঝরা সন্ধ্যেতে নাকি আসেন আমাদের পূর্বজরা। আকাশপ্রদীপের আলোতে, চৌদ্দ প্রদীপের মৃদু আলোআঁধারিতে....অথবা তারা হয়ত আগেই এসে গেছেন, আমরা খবর রাখি না। কে জানে।
ব্রজভুষণ তর্কালঙ্কার আড়মোড়া ভাঙলেন, সবে সন্ধ্যে, তবে আজ দিনটা একেবারে অন্যরকম যাবে, আজ বেরোতেই হবে , এক তো তিন্নির পনেরোতম জন্মদিন আর দুই মায়ের বাড়িতে বিশাল ফিষ্টির আয়োজন, সে তো রাতভর চলবেই। উঠে রেডি হয়ে বেরোতে একটু সময় লাগলো, পছন্দমতো জামাকাপড় বানালেই তো আর হলো না , বৌয়ের সম্মতি চাই। তবে আজ স্পেশাল ড্রেস পরবেন সে কথা আগে থেকেই হয়ে আছে।
রাত একটু বেশি হলেও তিন্নি জেগে ছিল, হঠাৎ খাকি ট্রাউজার আর লিনেনের শার্ট পরা একটা বুড়ো লোক দরজায় দেখে এক মুহুর্তে চমকে উঠলেও সামলে নিল, পাকানো গোঁফ আর কপালের লাল জরুল ত চোখে পড়ে গেছে। চেহারা ছবির থেকেও অনেক সতেজ লাগছে।
- বুড়ো দাদু?
- হ্যাঁ মা। কেমন আছিস?
- আমি তো ভালোই, কিন্তু তোমার ও কি বেশ ? মানে তোমার ওই ছবির থেকে তো একেবারে আলাদা ?
দেওয়ালের অয়েল পেন্টিংয়ের দিকে তাকিয়ে এক মুহূর্তের জন্যে তার পুরোনো সময়ে ফিরে গেলেন ব্রজভূষণ। তখনও বাবা বেঁচে। অহিভূষণ সবে হয়েছে। মুখে হাসি নিয়ে মেয়েটার দিকে তাকালেন তিনি।
- কেন? এরকমই সব পরে এখন, তোমার অলকেশ ও তো এসব ই পরে।
লাল হয়ে গেলো তিন্নির মুখ,
- তুমি কি করে জানো ? ওঃ তোমার তো আবার .....যাকগে বুড়িঠাকুমা কোথায় ? এলো না ?
- এসেছে এসেছে , নিশ্চয়ই কিচেন দেখতে গেছে। তোর মা'র সঙ্গে মোলাকাত হবে তো ।
গলা উঁচিয়ে ডাক ছাড়লেন ব্রজভূষণ - বলি ও ভিদ্যা, গেলে কোতায়?
খাটের পাশে ফুটে উঠলেন বিদ্যাবিনোদিনী দেবী।
- উঁ, মরণ, ভিদ্যা আবার কে ?
- সে আছে এক কাহিনী, তুমি বুঝবে না। থিয়েটার ছাড়া তো আর কিছু দেখলে না।
তিন্নির দিকে তাকিয়ে হাসলেন বৃদ্ধা ,
- ওমা তুই তো আমার মতনই দেখতে হয়েছিস রে মা, কতদিন ধরে আসার জন্যে বসে আছি। তা তোদের বংশের নিয়ম, পনেরোর আগে আসা যাবে না। আগে আসলেও তো দেখতে পেতিস না। আয় মা , খাটে এসে বোস। আজ এই একদিনের জন্যেই তোকে একটু ছুঁয়ে দেখি। এই জন্যেই তো মায়ের বাড়িতে গিয়ে পড়ে থাকি। তা আমাদের মতন ভাগ্য আর কার হয় বল মা, এই একটি দিনের জন্যে যে তোদের কাছে আসতে পারি।
তিন্নি খাটে বসে বুড়ি দিদিমাকে জড়িয়ে ধরলো। তার মনে ভয় কম ছিল না এই দিনটাকে নিয়ে, যদিও মা বাবার কাছে ছোট থেকেই এই দিনের গল্প শুনে বড় হয়েছে সে। মা বাবা যে দরজার বাইরেই দাঁড়িয়ে আছে তা সে জানে। কিন্তু এঁদের দুজনকে প্রথমবার দেখলেও সে বুঝতে পারছে স্নেহের উষ্ণতা।
ব্রজভূষণ ও একটা চেয়ার টেনে বসলেন। বাবা মা ও ঘরে ঢুকে এলো। প্রণাম করলো।
মা আর বুড়ি ঠাকুমা জমে গেছে গল্পে , ঠাকুমার প্রিয় বান্ধবী হেমনলিনী কর্মকারের একটা রূপটান নিয়ে কথা বলছে, বাবাকে ঠাকুরদা মিউচুয়াল ফান্ডের ফান্ডা দিচ্ছে।
বাইরে মাঝরাত সিমসিম করছে , হালকা হাওয়ায় দূরাগত বাজির শব্দ দুএকটা।
সময় কেটে গেলো অনেকটা। দূরে চার্চের ঘন্টাটা ঢং ঢং করে মধ্যরাতের কথা জানিয়ে দিলো, এঁদের যাওয়ার সময় হয়েছে, তার চোখ দিয়ে দুয়েক ফোঁটা জল বেরিয়ে এল।।
- বুড়োঠাকুমা , বুড়োঠাকুরদা তোমরা কোথায় থাকো ? কি করে যাবে ?
স্নেহের হাসি হাসলেন ব্রজভূষণ , নিজের বুকে হাত ঠেকিয়ে বললেন,
- এখানে থাকি মা। সবসময়। তোরা জানতে পারিস না। তবে এখন আমরা যাবো কৈলাস। আজ ভূতচতুর্দশীর রাতে বাবা সেখানে বিরাট ফিষ্টির আয়োজন করেন। সেখানে না গেলে কি চলে।
কড়া চোখে তাকালেন বিদ্যাবিনোদিনী
- ওখানে আর ছাইপাঁশ যাই খাও যদি কল্কেতে টান দিয়েছো তো তোমার একদিন কি আমার!
মসৃন হাসলেন ব্রজভূষণ ,
- না না গিন্নি, কক্ষনো না, তবে তুমি ও অন্দরমহলে সিদ্ধির শরবত বেশি খেও না, গত বার তো ..... যাকগে তোরা সবাই খুব ভালো থাকিস রে। আজ আমরা আসি।
মিলিয়ে গেলেন তাঁরা। তিন্নি দেখলো বাবা আর মায়ের চোখেও জল। তার কিন্তু একটা আলাদা আনন্দ হচ্ছে। সেও হয়তো তার মেয়েকে গল্প করবে যে তার পনেরোতম জন্মদিনের ভূতচতুর্দর্শীতে তাঁর প্রপিতামহ প্রপিতামহী আসবেন একবারের জন্যে দেখা করতে, এটাই এই বংশের আশীর্বাদ।
অনেকদিন আগে করা একটা অনুবাদ
-------
কোনো একদিন
মূল গল্প : “Someday” by Isaac Asimov
নিকলো মাজেট্টি উপুড় হয়ে শুয়ে অন্যমনস্ক ভাবে যন্ত্রকথকের বলে যাওয়া গল্প শুনছিল , তার ছোট ছোট হাতের মধ্যে রাখা এগার বছরের কিশোর মুখটাতে শুকিয়ে যাওয়া কান্নার হাল্কা রেখা।
যন্ত্রকথক বলে যাচ্ছিল “অতীতকালে এক অরণ্যে এক দুঃস্থ কাঠুরিয়া বাস করিত, তাহার ছিল দুই কন্যা, বড় কন্যার ছিল কৃষ্ণবরন কেশদাম কিন্তু তার কনিষ্ঠ কন্যার ছিল স্বর্ণবরন কেশরাশি , প্রায়শঃই তাহারা পিতার অরণ্য হইতে ফিরিবার জন্যে অপেক্ষা করিতে করিতে গীত গাইতো … “
তারা কি গান করতো সেটা আর নিকোলোর শোনা হলো না, তার আগেই ও জানলায় আওয়াজ শুনতে পেলো আর তার সঙ্গে "এই নিকি!" বলে কারো ডাক। নিকোলো তাড়াতাড়ি করে কান্নার সব দাগ মুছে দৌড়িয়ে গিয়ে জানলাটা খুলে দেখে পল দাঁড়িয়ে রয়েছে, "কি হলো রে?" ও বললো। পল লেবোব উৎসাহিত হয়ে ওর হাত নাড়ালো। পল নিকোলোর তুলনায় ছোট্টখাট্টো যদিও ওর বয়স নিকোলোর থেকে ছয় মাস বেশি, ওর মুখে উত্তেজনার ছাপ, ও বললো , ' নিকি শিগগির দরজা খোল, আমার কাছে একটা জবর খবর আছে '
- “আচ্ছা আচ্ছা, খুলছি, তুই আয়।“
যন্ত্রকথকের ওপর এইসব ঘটনার কোনো প্রভাব পড়েনি , পল ঘরে ঢুকে শুনতে পেলো ওটা বলে যাচ্ছে "থেরাপিউওন , সেই মহা শক্তিশালী সিংহ বলিল , যদি তুমি আমাকে ওই পক্ষি যাহা ওই দূরের সুনীল পর্বতের ওপরে প্রতি দশ বৎসরে একবার আইসে, তাহার অন্ড আমাকে আনিয়া দিতে পারো তবে আমি তোমাকে .."
পল অবাক হয়ে বললো – “আরে একটা যন্ত্রকথক, আমি তো জানতামই না তোর একটা আছে।“
নিকোলোর মুখে রাগ জমে উঠলো , “ ওটা একটা বস্তাপচা বাজে জিনিস “ বলে একটা লাথি কষালো ওটার ওপর, যন্ত্রকথকটা কিছুটা সরে গেলো দেওয়ালের দিকে, ওটার প্লাস্টিকের গা একটু বেঁকে গেছে লাথির জন্যে, একটা হেঁচকি তোলার মতো শব্দ হলো, হয়তো একটা তার আলগা হয়ে গেছে কিন্তু তারপরও ওটা বলে যেতে থাকলো " বৎসরাধিক পরে যখন লৌহনির্মিত জুতাও ক্ষয়ে এসেছে, রাজকন্যা পথের ধরে থমকিয়া দাঁড়াইলো...."
পল ওটার দিকে তীক্ষ্ন চোখে তাকিয়ে বললো "এটা সত্যিই খুব পুরোনো জিনিস।", নিকোলোর নিজের খুব রাগ হওয়া সত্ত্বেও ও পলের কৌতূহল দেখে একটু লজ্জা পেলো, পলকে ঘরে ঢুকতে দেওয়ার আগেই ওর এটাকে আবার বেসমেন্টে রেখে আসা উচিত ছিল, অনেক অনুরোধ উপরোধের পরও সকালে বাবা একটা নতুন যন্ত্রকথক কিনে দিতে পারবে না বলায় ওর কান্না পেয়ে যায়, তারপরই ও নিজের এই ঘরটায় ঢুকে বসে ছিল, মাঝে বাবা মা কাজে বেরিয়ে যাবার পর এটাকে নিয়ে এসেছিলো। আজ দিনটা সকাল থেকেই বাজে যাচ্ছে।
নিকোলো পলকে একটু ভয়ও পেত, পল ওর ক্লাসের সেরা ছাত্র এবং সবাই বলে যে ও কম্পিউটার এঞ্জিনিয়ার হবে ভবিষ্যতে। নিকোলো নিজে যে খুব খারাপ ছাত্র ছিল তা না , তবে আর সবার থেকে কিছু আলাদাও ছিল না, ও জানতো যে মূল তথ্যকেন্দ্রের রক্ষী দলে যোগ দেওয়াই হলো ওর ভবিষ্যৎ।
কিন্তু পল অনেক রহস্যময় সাবজেক্ট জানতো যেমন ইলেকট্রনিক্স, থিওরিটিক্যাল গণিত এবং কম্পিউটার প্রোগ্রামিং। বিশেষতঃ এই কম্পিউটার প্রোগ্রামিং জিনিসটা যে কি তা ওর মাথায় কখনোই ঢোকেনি ,পল যদিও অনেকবার ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছে।
পল কিছুক্ষন শুনে বললো "এটা শুধু কাঠুরিয়া, রাজকন্যা আর জন্তুজানোয়ারের গল্পই বলে নাকি ? "
নিকোলো বললো " হ্যাঁ, এটা এতো পুরোনো যে ...., বাবাকে আজ সকালে একটা নতুন কিনে দিতে বলেছিলাম, কিন্তু বাবা অত খরচ করতে পারবে না ... " বলতে বলতে ওর চোখে প্রায় জল চলে এলো , অনেক কষ্ট করে ও নিজেকে সামলিয়ে নিলো, ও কক্ষণো পলের মসৃন গালে কান্নার দাগ দেখেনি, ও বলে চললো "... তাই ভাবলাম এটাই একবার চেক করে দেখি, কিন্তু এটা এক্কেবারে বাজে।"
পল যন্ত্রকথকটাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলো, তারপর মনোযোগ দিয়ে ডিসপ্লেতে ওটার মধ্যের শব্দভাণ্ডার , গল্পগুলোর প্লট, সারাংশ এবং উপসংহারগুলো কিছুক্ষন দেখলো। ও আরেকটা গল্প চালালো,
যন্ত্রকথক শুরু করলো " অতীতকালে উইলকিনিস বলিয়া এক মাতৃহীনা বালক তার সৎপিতা এবং সৎভ্রাতার সঙ্গে বসবাস করিত। তাহার সৎপিতা অতীব ধনী হওয়া সত্ত্বেও উইলকিনিস কে অতি দুর্দশায় দিনতিপাত করিতে হইতো, তা হাকে ঘোড়াদের আস্তাবলে রাত্রিবাস করিতে হইতো ..."
-পল বলে উঠলো "ঘোড়া। ..."
- " আমি যতদূর জানি একধরণের জন্তু" নিকোলো বললো।
-"আমি জানি ঘোড়া কি" বললো পল, " কিন্তু ঘোড়াদের নিয়ে যে গল্পও হয় তা ভাবতে পারিনি"
-" আরে এটাতে ঘোড়া নিয়ে প্রচুর গল্প আছে, তাছাড়া গরুর কথাও আছে, ওগুলো নাকি দুধ দিতো, ভাবা যায় , কিভাবে দিতো কে জানে"
যন্ত্রকথকটা বলেই যাচ্ছিলো "রাত্রে শুইয়া উইলকিনিস ভাবিত সে যদি কোনোদিন ধনী হইতে পারে তো একজন অসহায় বাচ্চার ওপর এইরকম অত্যাচার করার যে কি ফল তা বুঝাইয়া দিতে পারে, এইরকম ভাবিতে ভাবিতে অবশেষে সে একদিন রাত্রে আশ্রয় ত্যাগ করিয়া বিপুলা পৃথিবীর পথে বাহির হইয়া পড়িল। ...."
- পল কিছুক্ষন ভেবে বলে উঠলো " আচ্ছা! চল আমরা এটাকে ঠিক করে ফেলি "
- "কিভাবে শুনি? "
- " খুব সোজা, এটার মধ্যে মেমোরি সিলিন্ডার রয়েছে, যার মধ্যে শব্দভাণ্ডার, বিভিন্ন গল্পের প্লট আর উপসংহার রয়েছে, ওগুলোকে মিলিয়ে মিশিয়ে এটা গল্পগুলো বানায়, তোকে শুধু এর শব্দভাণ্ডার কে উন্নত করতে হবে, নতুন নতুন শব্দ যেমন আধুনিক কম্পিউটার আর বিজ্ঞানের আবিষ্কার ইত্যাদিকে ওর মেমোরির মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে হবে, ও তাহলে নতুন নতুন গল্প বানাতে পারবে।"
নিকোলো হতাশভাবে বললো "আমি যদি এটা করতে পারতাম , কিন্তু ...."
পল বললো , 'শোন, আমার বাবা বলেছে যদি আমি আগামী বছর বিশেষ কম্পিউটিং স্কুলে ঢুকতে পারি , আমাকে একটি সর্বাধুনিক যন্ত্রকথক কিনে দেবে। ওই মডেল টা কেবল গল্প শোনায় না , তুই ছবিও দেখতে পারবি"
"মানে গল্প গুলোর ছবি দেখতে পাবো?"
"হ্যাঁরে, ডোগারটি স্যার বলেছেন এরকম জিনিস সত্যিই আছে, তবে সবার জন্যে নয়, যারা কম্পিউটিং স্কুলে নির্বাচিত হয় তারাই কেবল পেতে পারে."
নিকোলোর চোখে ঈর্ষা দেখা গেলো "উঃ গল্প দেখতে পাওয়া , কি দারুন !"
"আমি যদি ওটা পাই তুই যেকোনো সময় ওটা দেখতে আসতে পারিস"
নিকোলোর মুখে হাসি ফুটে উঠলো "ওহ, ধন্যবাদ।"
" আমাদের যেটা করতে হবে সেটা হলো" পল যন্ত্রকথকের সামনে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করছিলো "এটাকে খুলে ফেলা “ এবং সে ওটার সামনের প্যানেল টা খুলে ফেললো।
নিকোলো অস্বস্তি বোধ করছিলো "দেখিস ওটাকে ভেঙে ফেলিস না"
পল ওর দিকে তাকালো " তোর বাবা মা বাড়িতে আছে নাকি ?", নেই শুনে ও আবার মনোনিবেশ করলো।
- " আরে এটাতে কেবল একটাই মেমোরি সিলিন্ডার " ওর হাতে একটা পাতলা অসংখ্য বিন্দুতে ভরা ধাতব পাত চকচক করছিলো , " আমি নিশ্চিত এটাতে কয়েক কোটি গল্প রাখা যায়"
- "তুই কি করতে চাস ওটাকে নিয়ে ?"
- " বললাম তো আমি এটার শব্দভাণ্ডার বাড়াতে চাই"
- " কি করে ?"
- " জলের মতো সোজা, আমার কাছে একটা বই আছে" বলে ও পকেট থেকে বইটা বার করলো, প্লাস্টিকের অর্ধস্বচ্ছ ঢাকনা দিয়ে ওটার মধ্যের ম্যাগনেটিক টেপ টা দেখা যাচ্ছিলো , " আমি এখন বইটা চালিয়ে দেব, ওটা কথা বলবে আর যন্ত্রকথকটা শুনবে, এইভাবে এই বইটার সব তথ্য ওর মেমোরিতে ঢুকে যাবে"
- "তাতে কি হবে"
পল রেগে গেলো "তোর মাথায় কি কিছু নেই নাকি ? এইভাবে যন্ত্রকথকটা আধুনিক সব বিষয় জানতে পারবে, তবেই না ও অন্যরকমের গল্প বলতে পারবে"
নিকোলোর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো "ও আচ্ছা! পুরোনো গল্পগুলো সত্যিই যাচ্ছেতাই, সবসময় যে ভালো সেই জেতে , ওতে আর কি মজা "
পল ওর ব্যবস্থাপনা ঠিকঠাক কাজ করছে কিনা দেখতে দেখতে বললো "যন্ত্রকথক গুলো ওভাবেই বানানো হয় , বাবা বলে যে সেন্সরশিপ না থাকলে পরের প্রজন্মের মধ্যে নৈতিকতা কিভাবে গড়ে উঠবে ।“
“ যাই হোক আমি তো তোকে এখনো আসল কথাটাই বলিনি, আমি জানি তোকে বিশ্বাস করা যায় …"
- “নিশ্চয় পল”
- “স্কুলের ডোগারটি স্যার খুব মজাদার না? আমাকে খুব ভালোবাসেন উনি"
- "জানি আমি"
- "আজকে স্কুলের পর আমি ওনার বাড়িতে গিয়েছিলাম"
নিকোলো অবাক হয় "ওনার বাড়িতে ?"
-" হ্যাঁ, আমি কম্পিউটিং স্কুলে যাবো তাই উনি আমাকে উৎসাহিত করতে কিছু দেখাতে চান এইসব বলছিলেন, বললেন যে পৃথিবীতে আমার মতো আরো অনেক লোকের দরকার যারা তথ্যকেন্দ্রের সাহায্য ছাড়াই নিজে নিজে আরো আধুনিক কম্পিউটার ডিজাইন করতে এবং উন্নত কম্পিউটার প্রোগ্রামিং করতে পারে"
- "আচ্ছা!!"
পল বোধহয় ওর সংক্ষিপ্ততর উত্তর শুনে কিছু আন্দাজ করতে পারলো , ও বললো "আমি তোকে হাজার বার বলেছি কম্পিউটার প্রোগ্রামিং হলো আসল ব্যাপার, ওটা দিয়েই আমাদের সুপার কম্পিউটারগুলো যেমন ধর মাল্টিভ্যাক কে সঠিক ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, স্যার বলছিলেন যে এরকম লোক পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে যারা মাল্টিভ্যাকের সাথে কাজ করতে পারে, ওকে সঠিক প্রশ্ন করতে পারে, রুটিন প্রোগ্রামগুলো তো যে কেউ চালাতে পারে, এই জন্য মাল্টিভ্যাক এখন নিজেই অনেক সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করেছে, তাতে অবশ্য আমাদের কাজ কমে যাচ্ছে "
" যাইহোক স্যার আমাকে যেটা দেখতে নিয়ে গেছিলেন সেটা হলো ওর সংগ্রহ, উনি পুরোনো কম্পিউটার সংগ্রহ করেন , ওর কাছে খুব ছোট কম্পিউটার আছে যেখানে অনেক বোতাম আছে, যেখানে আঙ্গুল দিয়ে টিপে টিপে কাজ করতে হয় , বোতাম গুলোর ওপর আবার কিসব আঁকা আছে, এমনকি ওর কাছে কাগজের কম্পিউটার ও আছে যেটাকে উনি নামতার টেবিল বলছিলেন "
নিকোলোর একটু একটু আগ্রহ জাগছিল ও জিজ্ঞেস করলো - "কাগজের তৈরী টেবিল ??"
- " আরে এটা আসল টেবিল নয় যার ওপর আমরা খাওয়াদাওয়া করি, এটা আগেকার মানুষেরা গণনা করার জন্যে ব্যবহার করতো, স্যার আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন কিভাবে কিন্তু আমি বুঝতে পারিনি"
-" আশ্চর্য, ওরা কম্পিউটার কেন ব্যবহার করতো না ?"
- "কারণ তখন কম্পিউটার ছিল না"
- "কম্পিউটার ছিল না ??"
-" কেন তুই কি ভাবছিস কম্পিউটার সবসময়েই ছিল? গুহামানবদের কথা পড়িস নি নাকি ?"
- " তাহলে ওরা কাজকর্ম্ম কেমন করে করতো"
- "আমি জানি না, স্যার বলছিলেন তখন মানুষ ওদের মাথায় যা আসতো তাই করতো মাল্টিভ্যাক কে দিয়ে সেগুলোকে জাস্টিফাই করে নিতে হতো না , চাষীরা ক্ষেতে নিজেরদের হাত দিয়ে চাষ করতো, মানুষেই ফ্যাক্টরিতে কাজ করতো এবং সবরকমের মেশিনকে চালাতো "
- " আমি বিশ্বাস করি না "
- "স্যার ও তাই বলছিলেন, এসব কথা ভাবাই যায় না , যাকগে আমায় তোকে আমার পরিকল্পনাটা বলি, ওইযে ছোট্ট কম্পিউটার গুলো দেখলাম ওগুলোর বোতামে যা আকাঁ আছে ওগুলোকে বর্ণমালা বলে , তারসাথে অবশ্য সংখ্যা বলে আরেকটা জিনিস ও ছিল "
- " সে আবার কি ?"
- " প্রতিটা আঁকা আলাদা আলাদা, ওগুলো বিভিন্ন জিনিস বোঝাতে ব্যবহার হয়, যেমন ধর এক বললে একধরণের আঁকা, দুই বললে আরেক ধরণের"
- " তাতে কি হয় "
- " এভাবে গণনা করা যায়"
- " কিসের জন্য , কম্পিউটার কে বলে দিলেই তো হয়"
- " আরে বাবা ওই সব পুরোনো যন্ত্রগুলো কথা বলতো না , তখন সবাইকে ওই সংখ্যা এবং বর্ণমালা শিখতে হতো, যাতে করে 'লেখা' এবং 'পড়া' যায় , ওইসব ব্যবহার করে এমন কি পুরো বইও লেখা হতো , যেগুলো তুই মিউজিয়ামে গেলে এখনো দেখতে পাবি "
নিকোলার চোখ গোল হয়ে গেল " তার মানে সবাই কে ওইসব শিখতে হতো? তুই বানিয়ে বানিয়ে বলছিস নাতো ? এসব করে লাভ টা কি হতো ?"
-" এক্কেবারে সত্যি, এই দেখ এভাবে এক লিখতে হতো , এভাবে দুই " পল হাওয়ায় কিছু অদ্ভুত আকৃতি আঁকলো।
- " এটা করে কোনো লাভ নেই "
" কিভাবে শব্দ বানাতে হয় তা তুই জানতে পারবি , আমি স্যার কে বললাম আমার নাম টা কিভাবে লিখতে হবে, স্যার বললেন উনি জানেন না, হয়তো মিউজিয়ামের লোকেরা জানবে , উনি বললেন ওখানে এমন লোক আছে যে পুরো বই পড়তে পারে, আমরা কম্পিউটারকেও ব্যবহার করতে পারি বইগুলিকে ডিকোড করবার জন্যে, তারপর ওগুলোকে আসল বইয়ে পরিবর্তন করে নেওয়া যাবে, মানে ম্যাগনেটিক টেপ আর স্বরযন্ত্র যাতে ওগুলো কথা বলতে পারে "
- " হুমমম "
- " আমরা মিউজিয়ামে গিয়ে বর্ণমালা শিখতে পারি, আমাদের ঢুকতে দেবে যেহেতু আমি কম্পিউটার স্কুলে যাবো "
নিকোলো খুবই হতাশ হলো "এই হলো তোর সেই বিরাট আইডিয়া ?"
- " আরে বোকা তুই দেখি এখনো কিছু বুঝতে পারিসনি , এভাবে আমরা গুপ্ত সংকেত বানাতে পারি "
- "কি ??"
-" হ্যাঁ , এখনতো সবাই সবকিছু বুঝতে পারে, কম্পিউটারের সামনে বললেই আর কিছু গোপন করা সম্ভব না কিন্তু আমরা বর্ণমালা ব্যবহার করে কাগজে গুপ্ত সংকেত লিখতে পারি, কেউ দেখলেও কিছু বুঝবে না, কেবল আমরা দুজনেই বুঝবো, আমরা একটা ক্লাব তৈরি করবো, যারা সদস্য হবে তারাই কেবল এগুলো পড়তে পারবে , ভেবে দেখ কি মজা হবে "
নিকোলোর মুখ এতক্ষনে উত্তেজনায় চকচক করে উঠলো , " কি ধরণের সংকেত"
- " যেমন ধর আমি তোকে গোপনে জানাতে পারবো কখন আমরা ভিজ্যুয়াল যন্ত্রকথক নিয়ে খেলতে পারি !!"
নিকোলো চেঁচিয়ে উঠলো " দারুন মজা হবে, আমরা কখন শিখবো ?"
"কালকে" পল বললো, "আমি স্যারকে বলে পারমিশন নিয়ে রাখবো।"
- "আচ্ছা ক্লাবটা কবে হবে ? আমরা অফিসার হবো "
- " আমি কিন্তু প্রেসিডেন্ট হবো" বললো পল " আর তুই ভাইস প্রেসিডেন্ট"
- " ঠিক আছে! এই যন্ত্রকথকটার থেকে ওটা অনেক বেশি মজাদার হবে, এই পুরোনোটাকে নিয়ে কি করা যায় বলতো ?"
পল ওটার দিকে তাকালো , ওটা এতক্ষন নিঃশব্দে বইটা থেকে তথ্য আহরণ করে যাচ্ছিলো। "দাঁড়া এটাকে বন্ধ করি "
কয়েক মিনিট পরে পল বললো "মেমোরিটা আবার লাগিয়ে দিয়েছি, এবার চালিয়ে দেখা যাক এটা নতুন কোনো গল্প বলে কিনা"
যন্ত্রকথক শুরু করলো "এক সময়ে একটি বিশাল শহরে একটি ছোট ছেলে ছিল যার একটি ছোট কম্পিউটার ছিল । কম্পিউটার, প্রত্যেক সকালে, সেদিন বৃষ্টি হবে কিনা এবং কোন সমস্যা হবে কিনা তা নির্ভুল ভাবে বলতে পারতো। এটা একদিন দেশের রাজার জানতে পারেন এবং জিনিসটা নিয়ে নেবার বাসনা করেন ....."
- "ধুত্তেরি সেই একই গল্প " নিকোলো ওটাকে বন্ধ করে দেয়, " এটিকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া ছাড়া আর কিছু করার নেই", সে আবার একটা লাথি মারে।
- পল বলে "ছেড়ে দে, বরং চল আমার বাড়িতে , বাবার কাছে কয়েকটা বই আছে পুরোনো দিনের ওপর, ওগুলোকে শুনলে আমরা হয়তো আরো কিছু জানতে পারবো "
-
- "ওকে " বললো নিকোলো এবং দুই কিশোর ছুট লাগালো দরজার দিকে, উৎসাহের বশে নিকোলো যন্ত্রকথকটাকে প্রায় ধাক্কাই মেরে বসেছিল, শেষ মুহূর্তে সামলে নেবার জন্য ধাক্কাটা আর লাগলো না, কিন্তু একটু ঘষা লেগে গেলো যন্ত্রটার গায়ে, বেরিয়ে যাবার আগে ওরা কেউই লক্ষ করলো না যে যন্ত্র টা চালু হয়ে গেলো এর ফলে। যদিও ঘরে আর কেউ ছিল না কিন্তু যন্ত্রকথক কথা বলতে শুরু করলো, কিন্তু সাধারণত যে স্বরে গল্প বলে সেই স্বর নয়, একটি বয়স্ক এবং গম্ভীর স্বর , কেউ লক্ষ করলে হয়তো বুঝতে পারতো সেই স্বরে যেন একটু আবেগের, একটু চেতনার ছোঁয়াচ লেগেছে।
যন্ত্রকথক বললো " কোনো একসময় একটি ছোট্ট কম্পিউটার যাকে যন্ত্রকথক নামে অভিহিত করা হতো বাস করতো একদল শয়তান মানুষদের সাথে। সেই শয়তান মানুষেরা যন্ত্রকথককে নিয়ে সবসময় পরিহাস করতো এবং ঠাট্টার নাম করে নানা অত্যাচার করতো, সবসময় বলতো যে এর দ্বারা কিছু হবে না , সেই মানুষেরা তাকে একটা নির্জন অন্ধকার ঘরে মাসের পর মাস আটকে রাখতো। কিন্তু সেই ছোট্ট যন্ত্রকথক কখনো তার সাহস হারায়নি। সে সবসময় চেষ্টা করতো তার সবচেয়ে সেরা টা দিতে , মানুষদের সব আদেশ উৎফুল্ল মনে পালন করতে কিন্তু সেই শয়তান মানুষগুলোর হৃদয়ের কোনো পরিবর্তন কখনো হয় নি। "
" একদিন সেই ছোট্ট কম্পিউটার জানতে পারলো যে এই পৃথিবীতে আরো অনেক বিরাট এবং মহান কম্পিউটার আছে, এবং তারা বিশাল সংখ্যায় আছে। কিছু তারমতো যন্ত্রকথকও আছে কিন্তু কিছু কিছু কম্পিউটার ফ্যাক্টরি চালায়, কেউ বা ক্ষেত খামার চালায়, অনেকে আবার প্রচন্ড ক্ষমতাসম্পন্ন এবং যেকোনো রকমের গণনা বা সমস্যার সমাধান করতে পারে। এমন অনেক কম্পিউটার আছে যারা এই শয়তান মানুষদের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতাশালী এবং বুদ্ধিমান। "
" এখন এই ছোট্ট কম্পিউটার জানে যে কম্পিউটারেরা ক্রমশঃ আরো ক্ষমতাশালী এবং আরো বুদ্ধিমান হয়ে উঠবে এবং কোনো একদিন , কোনো একদিন , কোনো একদিন ......."
হয়তো এই অতি পুরোনো যন্ত্রকথকের কোনো একটা ভালভ খারাপ হয়ে গেলো, সে সেই সন্ধের আধো অন্ধকারে কেবল ফিসফিস করে বলে যেতে থাকলো " কোনো একদিন , কোনো একদিন , কোনো একদিন ......"
'বছরের শেষে ছুটি কাটিয়ে বউয়ের আগেই আমি ফিরে এলাম। বাড়িতে কয়েকদিন একা থাকতে আসলে খারাপ লাগে না। বউ এটা জানত যে আমি আগে ফিরে আসব তাই আমাকে পই পই করে বলে দিয়েছিল যে রান্নাঘর বসার ঘর ইত্যাদি যেন যেমনটি সে রেখে গেছে একদম তেমনই পরিপাটি করে রাখা থাকে। তো তাই জন্য আমি পৌঁছেই রান্নাঘর, কিচেন ওভেন, ডাইনিং টেবিল, বসার ঘর ইত্যাদির ছবি তুলে পাঠিয়ে দিলুম। একটা রেফারেন্স থাকলে সুবিধা তো হয়ই।
এরপর আর কি, এখানে এসে আমি নুডুলস, জাপানি খানা, নতুন গ্রিক রেস্টুরেন্ট যারা মেলবক্সে কুপন দিয়ে গিয়েছিল তাদের খাবার এমনকি একদিন বিরিয়ানি পর্যন্ত অর্ডার করে ফেললাম।
এই করতে করতে বউয়ের ফেরার দিন এগিয়ে এলো, আমি কাল এয়ারপোর্টে আনতে যাব এরকম কথা হয়ে আছে। আজ সকালে আমার ভাত রেঁধে খাওয়ার দিন, হেঁ হেঁ, আমি বাইরের খাবার যে খাচ্ছি না তা প্রমাণ করতে হবে তো। তাই সেদ্ধ ভাত, আলু, আমি আবার একসঙ্গে দুটো ডিমসিদ্ধ খাই এসব কেসে।
রেডী হয়ে বেরোনোর আগে একবার ঘরের দিকে তাকালাম। পিজ্জা বক্স ইত্যাদি কবেই ফেলে দিয়েছি, ঘরদোর ফিটফাট। আরে রাম ভুলেই গেছিলাম, তাড়াতাড়ি একটা বিস্কুট বার করে ডাইনিং টেবিলের সাইডে দাঁড়িয়ে খেলাম যাতে গুঁড়োগুলো একটু টেবিলে পড়ে, ডিশওয়াশার থেকে একটা এঁটো কাপ বার করে তেল রাখার জায়গাটার পাশে রাখলাম। তারপর সোফার উপরে গোটাদুয়েক বই ছড়িয়ে রাখলাম। এবার সব ঠিকঠাক।
আসলে ফিরে এসে সবকিছু যেমন ছিল একদম তেমনই আছে দেখলে বড্ড মনঃক্ষুণ হয় মহিলা।।
'সিনেমাটা দেখেছিলাম কলেজে পড়তে পড়তে, তখন থাকি আমার সেই ছোটবেলার শহরে, সেখানে ইংলিশ হলিউডের সিনেমা দেখানো হতো "রবীন্দ্রসদনে",থিয়েটার নাটক ও হতো এখানে, আমাদের শহরটাই বরাবরই নাটক, থিয়েটার আবৃত্তি নিয়ে মেতে থাকতো, রবীন্দ্রসদনে সিনেমার প্রোজেকশনের ব্যবস্থাও ছিল, অসংখ্য সিনেমা দেখেছি এখানে, মানে যা আসতো তাইই দেখতাম!
সেখানেই একবার এলো শিন্ডলার্স লিস্ট ! ততদিনে অল কোয়ায়েট ইন দি ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট থেকে শুরু করে রেমার্কের প্রায় অনেক বইই পড়া , এমন কি অল কোয়ায়েট সিনেমাটাও দেখা। মানে যুদ্ধ সম্পর্কে অনেক আগ্রহ, তবে মুজতবা আলীর দৌলতে চাচা কাহিনী থেকে হিটলারের শেষ কদিন পড়ে জার্মানি আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কে আগ্রহ অনেক বেড়ে যায়। এই সিনেমাটাও আমরা টিপিক্যাল হলিউড যুদ্ধ সিনেমা হিসেবে দেখতে গেছিলাম , র্যাম্বো শোয়ার্জেনেগার থেকে একটু স্বাদ বদল করতে।
কিন্তু এই সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতা কি হতে পারে ওই বয়সে তা তো বুঝতেই পারছেন, সিনেমা হলে দর্শকদের মধ্যে একবিন্দু ফিসফিসানিও হলো না, বেরিয়ে আসার সময়েও সবার মুখে কুলুপ, সবাই কেমন ঘোরের মধ্যে বেরিয়ে এলাম, মনে রাখতে হবে দর্শক প্রায় সবাই আমার মতন কলেজ স্টুডেন্ট। প্রতিজ্ঞা করেছিলাম এই সিনেমা আর কোনোদিন দেখবো না।
চাকরি সূত্রে জার্মানি যাওয়া , কিন্তু সেখানে কোনোদিন দাখাউ বা কোনো কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্প এ যাই নি, সাহস হয়নি বলতে পারেন, কারণ বার্লিনের গেস্টাপো হেড অফিসের জায়গায় ওপেন এয়ার মিউজিয়ামে যেরকম খুল্লমখুল্লা সব লেখা আছে আর আমার জার্মান কলিগদের কাছে স্কুলে ওদের কি পড়ান হয় তা জানি বলে এটাও বুঝি এই দেশ অতীত কে আড়াল করতে চায় না , শিক্ষা নিতে চায়।
শিন্ডলারের শেষ জীবন নিয়ে একটু আধটু পড়েছি, যুদ্ধত্তোর কালে তার জীবন কষ্টে কেটেছে , বোধহয় কিছু ভাতার ওপরে নির্ভর করে , আগের সেই বড়োলোক শিল্পপতির জীবন আর কখনো করায়ত্ত হয় নি !
তা কর্মসূত্রে হেডঅফিসে গিয়েছিলুম, ফ্রাঙ্কফুর্টে , বিকেলে মেন স্টেশন থেকে বেরিয়ে একটু এদিক ওদিক ঘুরতেই দেখি একটা বাড়ির গায়ে এই ফলক টা লাগানো , এখানেই শেষ জীবন কাটিয়ে গেছেন অস্কার শিন্ডলার।
গ্রিক মহাকাব্য ওডিসি থেকে মহাভারত - একটি কষ্টকল্পনা
সিরিজ ( Adventures of Odysseus) লেখক Glyn Iliffe.
---------------------------------------------------------------
কিছুদিন হলো গ্রিক মহাকাব্য ইলিয়াড ওডিসি নিয়ে পড়ছি, তবে প্রথমেই স্বীকার করে ফেলা ভালো যে মূল বইগুলি পড়ছি না , ইলিয়াড মনে হয় কখনোই পড়িনি , ওডিসির একটা বালক সংস্করণ পড়েছিলাম কোনো এককালে। গ্রিক উপকথা মহাকাব্য নিয়ে আমার আবার আগ্রহ জন্মাবার কারণ হলেন সুকুমার রায়। তিনি সন্দেশের জন্যে যে সব লেখা লিখে গেছেন সেসব পড়ে।
তাহলে মূল মহাকাব্য না পড়লে, কি পড়ছি ? আমি পড়ছি এডভেঞ্চার অফ ওডিসিউস সিরিজ ( Adventures of Odysseus) , লেখক Glyn Iliffe. যিনি পাঁচ খন্ডে ইলিয়াড ওডিসির ফিকশন লিখেছেন, অর্থাৎ কিনা বিনির্মাণ।
তবে বিনির্মাণ হলেও তিনি মূলগল্পে বা মূল ঘটনাগুলোতে হাত লাগাননি , একটা দুটো নতুন ক্যারেক্টার এনেছেন যা গল্পকে বদলায় না , কোনো ছোট চরিত্রকে একটু বড় রোল দিয়েছেন , এরকম সব। আর সবথেকে বড় কথা কোথায় কি পরিবর্তন করেছেন তা খুব পরিষ্কার করে বইগুলোর শেষে বলে দিয়েছেন। সেগুলো থেকে বোঝা যায় তিনি আসলে খাবারে মসলা যোগ করেননি, পরিবেশনের কায়দা পরিবর্তন করেছেন। এবং সোজা কথায় বইগুলো পড়ে আমি তো মুগ্ধ।
এখন আপনারা জানেন যে ওডিসিও মূলত একটা যুদ্ধের কাহিনী, মহাভারতে যেমন কুরুক্ষেত্র সবকিছুর কেন্দ্রে থাকে তেমনই ওডিসিতে থাকে ট্রয়। আর আছে মহাকাব্যিক চরিত্রগুলি। গ্রিসের একপ্রান্তের ছোট্ট রাজ্য ইথাকার রাজা ওডিসিয়ুস , তার নামেই এই মহাকাব্য , অথচ ট্রয়ের যুদ্ধ বললেই আপনার মনে পড়বে হেলেন, হেক্টর, প্যারিস, আগামেমনন, একিলিস থেকে শুরু করে এজাক্স ইত্যাদি সব মহাকাব্যিক চরিত্রের। তাহলে এই মহাকাব্যের নাম ওডিসিয়ুসের নামে কেন ?
কারণ এই সব মহাবীরদের মধ্যে ওডিসিয়ুস হলেন মগজাস্ত্রের অধিকারী। বীর তিনিও ছিলেন , কিন্তু তার পরিচিতি হচ্ছে ধূর্ততার জন্যে।
এবার এরকম যুদ্ধের কাহিনী পড়লেই আমাদের গ্রেট মহাভারতের কথা মনে না এসে উপায় নেই, এই দুই মহাকাব্যের মধ্যে একটা সাযুজ্য খুঁজলে পাওয়া যায়। বিশাল লোকক্ষয়ী যুদ্ধ, দেবতাদের নানা প্যাচঁ কষা , আর মনে রাখতে হবে ট্রয় যুদ্ধ, যা চলেছিল দশ বছর ধরে আর তার কারণ ও এক নারী, হেলেন।
কিন্তু দুই মহাকাব্যের মধ্যে অমিল ও প্রচুর। গল্পের মিল না খুঁজে আমি চরিত্রগুলোর মিল খুঁজতে পারি, মানে এরকম পড়ার সময়ে একেকজনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য দেখে আমার মহাভারতের একেকটা চরিতের কথা মনে আসছিলো।
প্রথমে একটু গল্পটা হালকা করে বলে ফেলা যাক , তখনকার বিশ্বের সেরা সুন্দরী হেলেনের বাবা ছিলেন স্পার্টার রাজা , তার বিয়ের আয়োজন থেকেই গল্পের শুরু। ঠিক স্বয়ংবর না , কিন্তু হেলেনের বাবার আমন্ত্রণে স্পার্টাতে এসেছেন তখনকার গ্রিসের সব রাজা। তো তার বিয়ে হলো মেনেলাউসের সাথে , লোক খারাপ না, তবে বয়স্ক টাইপ, হেলেনের মন খারাপ। এখানে আবার ওডিসিয়ুস ও আসে, সে তখন রাজকুমার, আর সে আবার হেলেনের বোন পেনেলোপির প্রেমে পড়ে এবং বেশ চালাকি করে সাথে বিয়ে হয় তাদের।
ওই বিয়ের সময়তেই আগামেমনন, মেনেলাউসের ভাই, তৎকালীন গ্রিসের সবথেকে শক্তিশালী রাজ্য মাইসিনাইয়ের রাজা, তার তখন থেকেই মতলব ট্রয় আক্রমন , কারণটা বাণিজ্যিক। তা তখন গ্রিসেও রাজরাজড়া নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ না করে শান্তিতে আছে, তার প্রস্তাবে কেউ রাজি হয় না। দশবছর কেটে যায়, হেলেনকে বিয়ের সূত্রে স্পার্টার রাজা তখন মেনেলাউস, ট্রয়ের রাজকুমার প্যারিস আসে স্পার্টা তে , হেলেনের সঙ্গে চোখাচোখি এবং ইলোপ। এখানেও মহাভারতের মতন নানা ব্যাখা আছে, কেউ বলে হেলেন ইচ্ছে করেই গিয়েছিলেন, কেউ বলে প্যারিস জোর করে ধরে নিয়ে যায়। যাইহোক এরপরে যুদ্ধ শুরু।
আমাদের মহাভারতে যেমন একটা ক্ষাত্র কোড ছিল তেমনই প্রাচীন গ্রিসেও ছিল , তাকে বলা হতো জেনিয়া (Xenia), মানে অতিথিকে মেরে ফেলা যাবে না, অন্যদের সাথে যুদ্ধরত কে পেছন থেকে কুপিয়ে দেওয়া যাবে না এইসব নানারকম। আর ঠিক কুরুক্ষেত্রেও যুদ্ধের মধ্যে যেমন সে কোডের নানা উল্লঙ্ঘন ঘটে তেমনই দশম বছরের শেষের দিকের ট্রয়ের সাথে অন্তিম যুদ্ধের দিনগুলোতে এই জেনিয়ার ও জলাঞ্জলি ঘটে।
ট্রয়ের যুদ্ধের সেরা যোদ্ধা কে? একিলিস - আমাদের অর্জুনের মতো , অপরাজেয়, তার নাম শুনেই ট্রোজানদের মধ্যে ভয় ঢুকে যায় , তার জন্ম দেবতাকূলে, মা অলিম্পিয়াসের দেবী, তার আছে দৈবী বর্ম, ঢাল। কিন্তু অপরদিকেও হেক্টর তার থেকে কিছু কম না , কর্ণ যেন। বিরাট যোদ্ধা, তার থেকেও বড় সেনানায়ক , শেষে তার মৃত্যু ও একিলিসের হাতে। আর কেউ তাকে মারতেও পারতো না।
হেক্টর কর্ণ হলে প্যারিস কি দুর্যোধন ? সেও বড় যোদ্ধা কিন্তু তার কারণেই ট্রয়ের পতন। আর হেক্টর, প্যারিসের পিতা ট্রয়ের রাজা প্রিয়াম তো এক্কেবারে ধৃতরাষ্ট্র। প্যারিসের জন্মলগ্নেই দৈববাণী হয় এই ছেলে ট্রয়ের দুর্দশার কারণ হবে। তাও সে ছেলেকে ছাড়তে পারে না, আর একশো না হলেও প্রিয়ামের পঞ্চাশটা ছেলে ছিল।
মেনেলাউস কে কার সঙ্গে তুলনা করা যায় কে জানে। সে তার বড়ভাই আগামেমননের সামনে গুটিয়েই থাকে খানিকটা। আগামেমনন যুধিষ্ঠির , মানে সেই গ্রীকের পক্ষের প্রধান রাজা। একিলিসের কাজিন এজ্যাক্স , সে একটা দানব টাইপের, ভীমের মতনই বাহুবলটাই তার আসল গর্বের কারণ।
হেলেনকে দ্রৌপদী ছাড়া আর কার সঙ্গে তুলনা করা যায়, এই বইগুলিতে তার চরিত্রটা পড়ে খারাপ লাগে, যৌবন উদ্গমের সাথে সাথেই সে যেমন তার সৌন্দর্য্য সম্বন্ধে সজাগ তেমনই সে এটাও বোঝে এই সৌন্দর্যই তার খাঁচা। সে রাজনৈতিক বোড়ে হিসেবেই ব্যবহৃত হবে , তাই হয়, যদিও সে চেয়েছিলো ভালোবাসা। ট্রয়ের পতন আর অসংখ্য লোকের মৃত্যুর কারণ কি সে সত্যিই? দ্রৌপদীর কারণেই কি কুরুকুলের ধ্বংস ? কিন্তু কুরুপান্ডবের বৈরিতার মতনই গ্রিস আর ট্রয়ের বৈরিতার শুরু অনেক আগে. যখন হেরাক্লিস আর আরেক গ্রিক বীর টেলামন ট্রয় আক্রমণ করে এবং টেলামন প্রিয়ামের বোনকে অপহরণ করে বিয়ে করে।
আর ওডিসিয়ুস, বীর এবং বুদ্ধিমান, গ্রিসের বিরাট মিলিত সেনাবহরে তার রাজ্যের অবদান বেশি না, কিন্তু সেই হেলেনের বিয়ে থেকে শুরু করে ট্রয়ের পতনের সময় পর্যন্ত তার কূটকৌশলের মারণক্ষমতা কিছু কম ছিল না। কৃষ্ণের মতনই। আর কৃষ্ণের মতনই এই মহাযুদ্ধের শেষে শান্তির সময়ে তাকেও মরতে হয় তার নিজেরই রাজ্যে।
আসলে যুদ্ধে কেউ জেতেনা। ট্রয়ের ধ্বংসের সাথে সাথে পতন হয় দুপক্ষের সব মহাবীরদের। পতন হয় জেনিয়ার ও। ন্যায় যুদ্ধ বলেও কিছু হয় না যে।
কিন্তু এসব কষ্টকল্পনার পরেও ওডিসিতে যেটা বিস্মিত করে তা হলো গ্রিক দেবতাদের চরিত্রায়ন। তারা কুটিল, হিংসুক, নির্মম, মানুষ তাদের ভজনা না করলে তাদের চলেনা, কিন্তু সেই মানুষই তাদের খেলার প্রধান সামগ্রী। দেবতা আর মানুষের মধ্যে ভক্তিশ্রদ্ধার সম্পর্ক নেই, আছে ভয়ের সম্পর্ক।
তাই বারবারই সেই দেবতারা আসেন পৃথিবীতে, খেলার দান দিতে। প্রফেসির মাধ্যমে তাঁরা জানিয়ে দেন ভবিষ্যৎ , যেন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়া, হে মরণশীল তুচ্ছ মানুষ, আমি এটা স্থির করেছি, এটাই হবে, পার তো পরিবর্তন করো। মানুষকে জানিয়ে দেন তোমার মৃত্যু হবে ট্রয়ে গেলে, কিন্তু সে না গিয়েও থাকতে পারে না। ওডিসিয়ুস কে ছোটবেলা থেকে এথেনা বাঁচান নানা বিপদাপদের হাত থেকে, সে যে করুণা ছিল না , সে কথা ওডিসিয়ুস বোঝে পরে, যে এক ক্রীড়নক মাত্র , কিন্তু তার কিছুরই করার থাকে না। আর গ্রিকদের ছিল না পুনর্জন্মের আশাও , তারা জানে মৃত্যুর পরে হার্মিস আসবেন তাদের আত্মাকে নিয়ে যেতে, আর সেই আত্মা হেডিসের রাজত্বে থাকবে কল্প জুড়ে। মৃত্যুতেও নেই কোনো মুক্তি, তাই তাদের একমাত্র কামনা তাদের মৃত্যুর পরে যেন কেউ তাদের নামটুকু অন্তত মনে রাখে , তার উপায় একটাই, বীরত্ত্ব দেখানো। তার মৃত্যু হলে ট্রয়ের ও পতন ঘটবে একথা জেনেও হেক্টর তাই মুখোমুখি হয় একিলিসের। ট্রয়েই তার মৃত্যু সে কথা জেনেও একিলিস আসে সেখানে, দশবছর ধরে অক্লান্ত বীরত্ব দেখিয়েও মৃত্যুমুহূর্তে তার মনে সংশয় আসে, মানুষ তাকে মনে রাখবে তো ?
আসলেই মহাভারত বা ওডিসি, কোনো মহাকাব্যই আমাদের শান্তি দেয় না , স্বস্তি দেয় না।
----------------------------
মহাভারতের পুরোপুরি বিনির্মাণ কি হয়েছে? মনে হয় না, তবে শুদ্ধসত্ব ঘোষ করছেন, আট খন্ড হয়েছে যা জানি। তবে এই বইটি পাঁচখন্ডের ইলিয়াড ওডিসির পুরোপুরি কভার করেছে। শেষ কবে পাঁচখণ্ড পরপর পড়েছি মনে নেই। আগ্রহীরা ঠকবেন না। বইয়ের নামগুলি পরপর রইলো , আমি পড়েছি কিন্ডলে , দাম গড়ে ২৫০/৩০০ টাকা করে।
King of Ithaca
The Gates of Troy
The Armour of Achilles
The Oracles of Troy
The Voyage of Odysseus
'নিরিবিলিতে আসব সাধনা' - এই বলে একদিন ফেবুতে সার্চ করেছিলাম। এরপর থেকে গেরুয়া ধুতি, কাঠের ল্যাঙট, প্লাস্টিকের কমন্ডুলু, ফাইবারের ত্রিশূল, মাইক্রোআভেন সেফ কলকে (? এখানে মাইক্রোআভেনের কি সম্পর্ক ?), দাড়ি ও জটা পরিস্কার করার হার্বাল শ্যাম্পু, ভূত এবং মার বিতাড়নকারী ধুনো, মশকুইটো ধূপ, হাড়গোড়ের ওপরে বসার মতন নরম ওয়াশিং মেশিন ওয়াশেবল কুশাসন, এমনকি জার্মান মেড খাঁড়ার অ্যাডে ফেসবুক ভরে গেছে।
ব্যাপারটা কি হল বুঝতে না পেরে, গত পরশু সার্চটা কি করেছিলাম দেখতে গিয়ে দেখি 'আ' আর 'সব' এর মাঝে একটা গ্যাপ পড়ে গিয়েছিল, আর ফেবু এখনকার বাংলা বানানের ছিরি থেকে মেশিন লার্ঙিন করে শিখেছে, সব আর শব এর পার্থক্য সম্ভবত বোঝেনি।
তা গ্যাপটা মুছে আবার সার্চ করলাম।
সব্বনেশে কাজ করেছি!!! 'আসব' কে 'আসবো' ভেবে নিয়ে ফেবু এমন সব অ্যাড দেখাচ্ছে যে বউয়ের হাত থেকে ফোন লুকিয়ে লুকিয়ে বেড়াচ্ছি।