শাংগ্রিলার খোঁজে - পরিমল ভট্টাচার্য
প্রকাশনা: অবভাস। 300/-
বইটির নাম দেখে পড়ার তেমন ইচ্ছে ছিল না, শাংগ্রিলা, জ্ঞানগঞ্জ ইত্যাদির নামে অনেক বই পড়েছি, সবই ধর্মীয়, হিমালয়ের বুকে সেই রহস্যময় লুকানো উপত্যকা নিয়ে আরেকটা বই পড়ার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু বইটার হেডিঙের নিচে যে হিমালয়ের গুপ্তচারণার তিনশতক, এইটা চোখে পড়েনি। চোখে পড়তেই যে নামটা মনে এলো তা হলো শরৎচন্দ্র দাস!
একসময়ে ফার ইস্ট ব্যাপারটা পশ্চিমা সমাজে একটা নেশার চেয়ে বোধহয় কম ছিল না। কিন্তু পরাধীন ভারতবর্ষে ইংরেজদের কাছে আরেকটা অগম্য জায়গা ছিল, তিব্বত। তিব্বত তখনও বহিরাগতদের জন্য কঠোরভাবে নিষিদ্ধ, হিমালয়ের আড়ালে চিররহস্যের দেশ। সেই রহস্য যেমন সেখানে বসবাসকারী মানুষ ও তাদের জীবনধারা ঘিরে, তেমনই তার বিচিত্র দুর্গম ভূপ্রকৃতি ঘিরেও। এদিকে ততদিনে এই উপমহাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মানচিত্রে উঠে এসেছে, অগম্য অনাবিষ্কৃত বলতে প্রায় কিছুই অবশিষ্ট নেই আর। সেই মানচিত্রে গোটা উনিশ শতক জুড়েই তিব্বত একটি দগদগে সাদা শূন্যস্থান। অজানার হাতছানি তো ছিলই, এছাড়াও তিব্বতের ওপারেই ছিল প্রবল শক্তিধর রাশিয়া ও তার সাম্রাজ্যবাদী অভিসন্ধি , পৃথিবীর ছাতের ওপর এই দেশটিকে জানা তাই কূটনীতির তাগিদেই জরুরি হয়ে পড়েছিল ব্রিটিশ শাসকদের কাছে। ছিল অর্থনীতিও। তিব্বতে ভিনদেশিদের জন্য দরজা বন্ধ ছিল, কিন্তু পণ্য যাতায়াতে মাঝে গিরিপথ দিয়ে সমতলের সঙ্গে বাণিজ্য চলত সেই প্রাচীনকাল থেকেই। গাঙ্গেয় ভূমি থেকে রেশম, ধাতু ও হাতির দাঁতের সামগ্রী, নুন আর খাদ্যশস্য যেত পাহাড় ডিঙিয়ে ; ওদিক থেকে আসত পশম, ঘি, চামড়া, চমরি গাইয়ের লেজের চামর ইত্যাদি।
এই তিব্বতেই তো গিয়েছিলেন শরৎচন্দ্র দাস। বইটি পড়ার আগ্রহ জন্মালো। পড়তে গিয়ে দেখি দুইটি সমান্তরাল ধারা বয়ে চলেছে। যুবক বয়সে পাহাড়ি অঞ্চলে প্রথম চাকরি করতে গিয়ে লেখক যে নিসঃঙ্গতার কবলে পড়েন আর তা থেকে ধরা পড়েন বহু বছর আগে দার্জিলিং থেকেই রওয়ানা হওয়া এইসব তিব্বত অভিযানের গল্পে, এই দুই ধারা ।
নিঃসঙ্গ যুবকের মনে ওঠে " দুর্গম পাহাড়ের গা, পাইনবনের নীচে নীলাভ তৃণভূমি, আকাশের গায়ে বরফে ঢাকা পাহাড়চুড়ো, গহীন উপত্যকার বুক চিরে বহতা নদী, ধোঁয়ার কুণ্ডলী ওঠা গ্রাম: টুকরো টুকরো ছবি, এক শাশ্বত দৃশ্যপট থেকে খুলে এসে অপেক্ষা করে আমার দরজার বাইরে, ভেতরে আসতে চায়। আমি গিয়ে দরজা খুলে দিই।"
"সিমলার মল রোডে মারিয়া ব্রাদার্স বুকশপের দরজা খুললে একটি ঘণ্টা টুং করে বেজে উঠত একবার। সেই তীক্ষ্ণ নিস্বন ঘরের ভেতর পুরোনো বইয়ের গন্ধে ভারি বাতাস আর মথ-ওড়া আলোছায়ায় মিশে এক বিচিত্র উত্তেজনা সৃষ্টি করত, একটা রহস্যের খিদে চারিয়ে যেত ভেতরে।", লিখছেন লেখক।
কত কিছু অজানা ছিল। পন্ডিত কিন্টুপ ! নিরক্ষর এক দর্জি কি করে পন্ডিত উপাধি পেলো? ১৮৭৯ সালে কিন্টুপকে সাংপো নদের রহস্য সন্ধানে পাঠানো হল! সে সফল ভাবে শেষ করে সেই অভিযান, অকথ্য কষ্ট পেয়ে, দাস বৃত্তি করে। কিন্তু ফিরে আসার পরে কোনো স্বীকৃতি?
তারপর যান শিক্ষিত বাঙালি যুবক শরৎচন্দ্র!
"দূর পাহাড়ের কোলে বিজন নিঝুম গ্রাম, শীতঘুমে সেঁধিয়ে এসেছে, বিকেলবেলায় মেয়েরা কাঠের বালতি হাতে বেরিয়ে এসে শিস দিয়ে ডাকছে ; চমরিঘণ্টার শব্দ, কুয়াশা, বরফ— তার ভেতর দিয়ে নিশি-পাওয়ার মতো পদক্ষেপ গুনে চলেছে এক বাঙালি যুবক ; সবুজ গুপ্ত উপত্যকায় ভোর ফুটছে, স্ফটিক পাহাড়ের মাথায় সূর্যের প্রথম আলো, নীচে ঘুমিয়ে থাকা ছোটো ছোটো গ্রাম, নিস্তব্ধ ; ক্রমশ আলোর রশ্মি নেমে আসছে তুষাররেখার নীচে, ঘন জুনিপারের জঙ্গলে আলো ঢুকছে, স্থির স্বচ্ছ বাতাসে ভেসে আসছে রিনরিন ঘণ্টাধ্বনি। জঙ্গল বুঝি জাগছে মৌচাকের মতো। চমরির গলার ঘণ্টা, বনের ফাঁকে চৌরিখাঙে স্থির হয়েছিল সারারাত, সূর্যের তাপে নড়েচড়ে বেজে উঠছে। ঘণ্টা বেজেই চলে।..."
ফিরে এসেছিলেন শরৎচন্দ্র, তাঁর ভ্রমণের একটা ভালো আইডিয়া পাঠক পাবেন এই বই থেকে, কিন্তু বাস্তবে এই অভিযান ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী ইতিহাসের একটি রক্তাক্ত অধ্যায়। তাঁর আনা তথ্যে ভর করে অত্যাধুনিক ম্যাক্সিম বন্দুকে সজ্জিত গোর্খা ও শিখ রেজিমেন্টের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আদিম ম্যাচলক রাইফেল নিয়ে লড়াই করতে গিয়ে হাজার হাজার তিব্বতি সৈন্য প্ৰাণ হারায়, ব্যাপক লুঠপাট চলে অসংখ্য মঠে গোম্ফায়, দলাই লামা পালিয়ে যান মোঙ্গোলিয়ায়, ব্রিটিশ সামরিক শক্তির চাপে পাহাড়পারের নিষিদ্ধ দেশ খুলে যায় ঝিনুকের মতো।
সর্বনাশ নেমে আসে তিব্বতে যারা তাঁকে সাহায্য করেছিল তাদের ওপরেও। এই সময় থেকেই সরকারি মহলে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েন শরৎচন্দ্র দাস । বিস্মৃতির আড়ালে হারিয়ে যেতে থাকেন তিনি!
কিন্তু শুধু এইটুকুই তো নয়। সেই পথ ধরে গিয়েছে অনেক মানুষ— গুপ্তচর যোদ্ধা প্রেমিক প্রকৃতিবিদ। হাঙ্গেরি থেকে কোরোসি চোমা এসেছিলেন নিজের জাতির উৎস সন্ধানে। সুদূর অতীতে হাঙ্গেরিয়রা চিন বা মধ্য এশিয়ার কোনো একটি পার্বত্য অঞ্চল থেকে এসেছে, এমন একটা প্রবাদ ছেলেবেলা থেকেই শুনে এসেছেন কোরোসি। বড়ো হয়ে তার সত্যতা নির্ণয় করতে বেরিয়ে পড়লেন। ১৮১৯ সালে যখন যাত্রা শুরু করলেন, কোরোসি চোমার বয়স ৩৫ বছর।তখন রাশিয়ায় মহামারী লেগেছে, পূর্বপরিকল্পনামাফিক সাইবেরিয়া দিয়ে যেতে পারেননি কোরোসি। ক্রোয়েশিয়া থেকে বুখারেস্ট হয়ে কনস্ট্যান্টিনোপল, সেখান থেকে আলেক্সান্দ্রিয়ার একটি জাহাজে চড়ে বসেন। কিন্তু ততদিনে মহামারী ছড়িয়ে পড়েছে ওই অঞ্চলেও। নিরাপদ বন্দরের খোঁজে তাঁদের জাহাজটি পূর্ব ভূমধ্যসাগরে চলার পর অবশেষে ভিড়ল এসে সিরিয়ায়। সেখান থেকে অবশেষে একদিন দাজিলিং। পারেননি তিনি আর এগোতে?
আলেক্সান্দ্রা ডেভিড নীল - অভিযাত্রীদের ভিড়ে ভাস্বর এই অভিযাত্রিণী। অবিশ্বাস্য তাঁর যাত্রা। এই মুলুকে এসেছিলেন প্রাচ্য অধ্যাত্মবাদ আর বৌদ্ধধর্মের টানে, বিশ শতকের গোড়ায়। সিকিমে এসে যুবরাজ সিদকিয়ং টুলকু নামগ্যেলের সঙ্গে পরিচয় হল। যুবরাজ ছিলেন একাধারে দীক্ষিত লামা, অন্যদিকে আবার অক্সফোর্ডের ডিগ্রিধারী, বহু ভাষাবিদ। ইয়ংদেন নামে এক চোদ্দ বছরের বালককে দত্তক নিয়েছেন। সেই ইয়ংদেনকে সঙ্গে নিয়ে বর্মা জাপান মোঙ্গোলিয়া কোরিয়া ও চিন হয়ে তিব্বতে পৌঁছোলেন আলেক্সান্দ্রা, লাসায় গিয়ে দেখা করলেন দলাই লামার সঙ্গে। দীর্ঘ বারো বছর ধরে সেই যাত্রা ছিল বিচিত্র সব অভিজ্ঞতায় ঠাসা। সুবিশাল চিন ভূখণ্ড আড়াআড়িভাবে পূর্ব থেকে পশ্চিম অতিক্রম করেছেন, তিব্বতি বৌদ্ধধর্ম তন্ত্র ম্যাজিক ইত্যাদি নিয়ে কুড়িটিরও বেশি বই লিখেছেন। এরপরেও বেরিয়েছেন, চিনে গিয়েছেন জাপানি সাম্রাজ্যবাদের আমলে, সেখান থেকে দীর্ঘ পথ ঘুরে ভারতে এসেছেন। সিকিমে এবং দার্জিলিঙে এসেছেন একাধিকবার। দার্জিলিঙে এলে উইন্ডামিয়ার হোটেলে যে স্যুইটটিতে উঠতেন সেটি তাঁর নামাঙ্কিত হয়েছে। ১৯৫৫ সালে ইয়ংদেনের মৃত্যুতে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন, তবু শেষদিন পর্যন্ত লেখাপড়া চালিয়ে গিয়েছেন। ১৯৬৯ সালে আলেক্সান্দ্রার মৃত্যুর পর তাঁর ও ইয়ংদেনের চিতাভস্ম ভারতে এনে ভাসানো হয় বারাণসীর গঙ্গায়, ঠিক যেমনটি চেয়েছিলেন তিনি।
তাহলে শাংগ্রিলা? দার্জিলিং থেকে যাত্রা শুরু করে কিন্টুপ ফিরে এসেছিলো বর্তমানের অরুণাচল প্রদেশ দিয়ে, পর্বতের গহীনে সাংপোর তীরেই কি সেই উপত্যকা? লেখক তা দেখতে বার হন অরুণাচলের পথে। তাঁর দেখা হয় শাঙ্গে দোরজির সাথে। চীন যুদ্ধের সময় লড়া এক সৈনিক ! তুষার ঝড়ে আটকে থাকার সময়ে একরাতে খুলে যায় সেই বুড়ো সৈনিকের মুখ ! ১৯৬২ সাল! যুদ্ধ শেষ হয়ে গিয়েছে প্রায় একমাস আগে, বরফের নীচে চাপা পড়ে রয়েছে শিখ লাইট ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের জওয়ান সব, লড়াইয়ে যত না মরেছিল আহত হয়ে ঠান্ডায় জমে মরেছিল তার থেকে বেশি। গায়ে সুতির ইউনিফর্ম আর পায়ে ক্যানভাসের জুতো ছাড়া আর কিছু বিশেষ ছিল না ওদের। লম্বা চওড়া স্বাস্থ্যবান তরুণ সব, কতই বা বয়স। উত্তর ভারতে কোথায় কোন নদীর ধারে গ্রাম। সেখানে জন্মেছে, বড়ো হয়েছে। কত দূরে কোন পাহাড়ে এসে মারা পড়ল । দশদিন ধরে চলছিল বরফের দেশ থেকে মৃতদেহ খুঁজে সৎকারের কাজ। চাকরি থেকে অবসর নেবার পর শাঙ্গে ফিরে এসেছেন জন্মভূমিতে। এসব অনেককাল আগের কথা। তবু আজও নীচের বন থেকে লতাপাতার বোঝা নিয়ে ফিরে আসার সময় আচমকা কখনো পিঠে ফিরে আসে সেই ভার, দূর পাহাড়ে চিকচিক করে ওঠে সেই স্মৃতি, স্বচ্ছ তুষারের নীচে থেকে চেয়ে থাকে খোলা চোখগুলো, আশ্চর্য অবিকৃত, বরফে জমাট ছোপ ছোপ রক্ত যেন রডোডেনড্রনের পাপড়ি বিছিয়ে রয়েছে।
চমরিঘণ্টার ধ্বনি ভেসে আসে, দুশো বছর আগে শিখ ইনফ্যান্ট্রির সৈন্যরা মরেছিল অজানা তিব্বতে, স্বাধীন ভারতেও ! এর মাঝে তিব্বতের পথে গেছে কত মানুষ। তারা লুটেরা সাম্রাজ্যবাদী ছিল না সবাই। হিমালয় মানুষকে আকর্ষণ করে। সেনানায়ক ফ্রান্সিস ইয়ংহাজবেন্ড যিনি তিব্বতে আক্রমণ করেন, তিনিও সেই আকর্ষণ থেকে বার হতে পারেননি। কিন্তু শাংগ্রিলা অধরাই থেকে যায়।
কিন্তু পথ আর অভিযাত্রীদের কাহিনী শেষ হয় না। সেই দিক থেকে এই বইটি পড়া এক দারুন অভিজ্ঞতা।
মিত্র ও ঘোষ ( বর্তমান দাম জানা নেই, মিত্র ও ঘোষের ওয়েবসাইটে ( co.in) দেখতে গেলাম, তো SQL Server এরর দেখাচ্ছে, কে জানে এটাই আসল সাইট কিনা )
গজেন্দ্রকুমারের লেখনী সম্বন্ধে বেশি কিছু বলার প্রয়োজন পড়ে না। তবে আমার কেমন যেন মনে হয় পাঞ্চজন্যের জন্যেই উনি বাঙালির কাছে কেমন চাপা পড়ে গেলেন। এই সাধুসঙ্গ বইটা অনেক আগে লাইব্রেরি থেকে পড়া, কথা প্রসঙ্গে বইটির কথা উঠতে দেখলাম গল্পগুলোর একটাও ভুলে যাই নি। তার কারণ গল্পগুলোর প্রায় একটাও সাধুসঙ্গ ধরণের বইগুলো মতন সরলরৈখিক না। মানে সাধারণ মুমুক্ষ সাধুসঙ্গ পেলেন, তার ঐশী ক্ষমতা দেখে চমৎকৃত হলেন না কোনো উপকার পেলেন, ভক্তিভাব এলো, ঠিক এরকম না। বরং কয়েকটি তো বেশ অন্যরকম ভাবে লেখা।
বইটার মুখবন্ধ মনে নেই, তাই ঠিক খেয়াল করতে পাচ্ছি না যে লেখক এগুলোকে গল্পই না নিজের অভিজ্ঞতা বলেছেন। কিছু গল্প উত্তম পুরুষে আছে, কিছু শোনা। গল্পগুলির মধ্যে আরেকটা ব্যাপার আছে, সেটা হলো সাধিকাদের বেশ ভালো মতন উপস্থিতি। তবে প্রায় সবক্ষেত্রেই সুন্দরী, বা আগে সুন্দরী ছিলেন সেই সাধিকারা এটাই প্রথমে গল্পকারের চোখে পড়েছে দেখা যায়। সম্ভবত লেখক আমাদের একটু খোঁচা দিতে চেয়েছেন।
প্রায় প্রতিটি গল্পই ওপেন এন্ডেড, মানে পারফেক্ট ছোট গল্পের বৈশিষ্ট আছে , শেষ হইয়াও হইলো না শেষ। বইটার প্রথম গল্পটাই বেশ শকিং, নাম ইচ্ছামৃত্যু। না যেমন ভাবছেন ঠিক সেরকম না। এই ইচ্ছামৃত্যু গল্পটাতে এক সন্ন্যাসী, মোহান্তের উপলব্ধি হয় যে তিনি আসলে প্রানভরে সব কিছু বাদ দিয়ে ঈশ্বরকে কখনোই ডাকেননি। সংসারত্যাগী হয়েও আশ্রমের আরো বড় সংসার নির্বাহ করে গেছেন। এই উপলব্ধি যে সময়ে আসে সেটাই শকিং, যখন তাকে সংসার মৃত মনে করে ত্যাগ করে গেছে তখন প্রকৃতির অপূর্ব নির্জনতার মধ্যে সবকিছু বাদ দিয়ে ঈশ্বরকে ডাকার মধ্যে যে আনন্দ আছে সেটা তিনি বুঝলেন, তবে সে বোঝার অর্থ আর কি থাকলো।
গল্পগুলোর বিবরণ দেব না , শুধু আরেকটি গল্পের উলক্ষে করে ছেড়ে দেব, স্পয়লার হচ্ছে একটু, তবে আমি বলতে পারি এ সত্ত্বেও গল্পগুলো পড়ার রস পেতে আপনার অসুবিধা হবে না।
এবার ধরুন এক প্রৌঢ় সন্যাসীর প্রেমে পড়লো অষ্টাদশী, সে দীক্ষাই চায় বটে তবে তার চাওয়া ঈশ্বর নন, এই মানুষটি। এরকম গল্পের শেষ আমরা জানি, কোন না কোন ট্রাডেজি, নয় কি ? এখানেও তাই হলো সন্ন্যাসী দেহত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। কিন্তু আরো দশক দুই পরে যৌবনোত্তীর্ণা অবিবাহিতা সেই নারীর প্রেমে পড়লো তার অর্ধেক বয়েসের এক ছেলে। ইনি ও থাকলেন না অনাহতা। কিন্তু কে এই ছেলে, তার হাতের কড়ে আঙুলের একটি গাঁট নেই কেন? বুঝলেন ???
যদি জোগাড় করতে পারেন পড়ে ঠকবেন না, একটাও গল্প গদগদ ঈশ্বরপ্রেম বা সাধুসঙ্গের না।
কেন ফলেটের "দ্য পিলারস অফ দ্য আর্থ" সিরিজ এবং "দ্য ইভনিং অ্যান্ড দ্য মর্নিং" পড়লাম, এই দুই বইয়ে বেশ কয়েকটি মিল রয়েছে, দুটো উপন্যাসই ইংল্যান্ডের কাল্পনিক শহর কিংসব্রিজের ওপরে।
"দ্য পিলারস অফ দ্য আর্থ", ইতিহাস ভিত্তিক ফিকশনের মধ্যেও সাধারণত রাজরাজড়ার কাহিনীই থাকে, সে হিসেবে এই বইটি ব্যতিক্রম। ১১১০-১১৫০ সালের মধ্যের ইংল্যান্ড, রাজা প্রথম হেনরি মারা যাওয়ার পরে সিংহাসন দখল করা রাজা স্টিফেন আর আরেক দাবিদার ম্যাটিলডার মধ্যের যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয় তা পরিচিত The Anarchy হিসেবে। কিন্তু এই অস্থির সময়ের প্রেক্ষাপটের এই গল্পে এঁরা মূল চরিত্র না।
মূল চরিত্র ফিলিপ, কিংসব্রিজ নামের একটা অজ গাঁয়ের গুরুত্বহীন ক্যাথিড্রালের প্রায়র সে, প্রাচীনকালের এই ক্যাথিড্রাল ভেঙে পড়তে পড়তে একসময় আগুনে ধ্বংসই হয়ে যায়। ফিলিপ আদ্যন্ত ধার্মিক, কিন্তু সে মনে আর মুখে এক, তাই সাধারণ মানুষকে বাচাঁতে গিয়ে বার বার থাকে সামনা করতে হয় তার থেকে অনেক বড় শক্তির, তার এই ক্যাথিড্রালকে গড়ে তোলার প্রচেষ্টাই গল্পটির মূল ব্যাপার। কিন্তু ঘটনাবহুল এই বইয়ে আছে আরো আরো চরিত্র, টম বিল্ডার, এক দরিদ্র মিস্ত্রি, তার আজীবনের ইচ্ছে একটি ক্যাথিড্রাল তৈরির সময়ে মাস্টার বিল্ডার হিসেবে কাজ করা, কারণ? কারণ সে একটা সুন্দর বিল্ডিং বানাতে চায়, আর আছে বিলাসবহুল জীবন থেকে সহসাই পথে এসে দাঁড়ানো এক পরাজিত আর্লের সপ্তদশী কন্যা এবং তার ছোটভাই, তাদের বেঁচে থাকার সংগ্রাম, আরেক আর্ল পরিবারের সঙ্গে সংঘর্ষ, চার্চের বিশপ থেকে আর্চবিশপ হয়ে ইংল্যান্ডের রাজসভার রাজনীতির চাল.. আর শৈশবেই পিতৃমাতৃহীন ফিলিপের ধার্মিক জীবন থেকে আস্তে আস্তে রাজনৈতিক কুটনৈতিক জীবনে অনিচ্ছুক ভাবে জড়িয়ে যাওয়া। কিন্তু তার মধ্যেকার ভালোমানুষটি কখনো মরে না, ঈশ্বর, চার্চের জন্যে নিবেদিতপ্রাণ এই লোকটি কখনো ছেড়ে যায়না তার আশেপাশের অসহায় মানুষগুলিকে, তার সীমিত সাধ্য সত্ত্বেও। আছে রহস্যও, এলেন নামের একটি মেয়ে, যার প্রথম ভালোবাসার মানুষটির সঙ্গেই ঘটেছিল এক অন্যায়, সমাজের উঁচুতলার লোকদের হাতে, সেও ঘুরে ঘুরে আসে এই কাহিনীতে।
কি বিশাল প্রেক্ষাপট এই বইটির, অথচ গল্পের কাহিনী এগিয়ে চলে কেবলমাত্র সাধারণ মানুষের আকিঞ্চনের মধ্যে দিয়ে, প্রেম, ভালোবাসা, বিশ্বাসঘাতকতা, আত্মত্যাগ, অন্যায়,পরাজয়, সবমিলিয়ে এক অত্যন্ত স্বাদু জীবনের কাহিনী।
"দ্য ইভনিং অ্যান্ড দ্য মর্নিং" ইংল্যান্ডের ভাইকিং আক্রমণের এর পটভূমিতে 997 খ্রিস্টাব্দ থেকে 1007 সাল পর্যন্ত সময়কাল জুড়ে।
কেন ফলেটের লেখা ঘটনাবহুল না। পোয়েটিক জাস্টিস ও না। আবার রাজারাজড়ার কাহিনীও না। সাধারন মানুষের গল্প মৃলত, শাসক আর চার্চের অশুভ নেক্সাসে পড়ে মধ্যযুগে মানুষের কি হাল হত তা বেশ বোঝা যায়। শেষে জাস্টিস হয় বটে, তবে তার মূল্যও কম দিতে হয় না। তবে শেষ পর্যন্ত দুই প্রোটাগনিস্ট মিলে গেলে আর সমস্যার কি। এই লেখাগুলোর একটা বড় ব্যাপার অন্তত একটা শক্তিশালী নারী চরিত্র। তবে নারী মাত্রই সাধু, আর পুরুষদের সব দোষ, এই ক্লিশে ব্যাপারস্যাপার ও নেই। সবাই ক্ষমতা চায়। সে বাড়ির মধ্যেই হোক বা তার বাইরে।
একটা ভালো ফিকশন বই থেকেও যে আসল ইতিহাসের প্রতি আগ্রহ জন্মাতে পারে তা আমি জানতাম, অনেকসময়ই একটা গল্প পড়ে সেই সময়ের ইতিহাস উল্টে পাল্টে দেখছি, তবে এই সিরিজ টা প্রায় ৯০০ বছর ধরে, ইংল্যান্ডের মধ্যযুগের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো আছে সবই, কিন্তু সেগুলো গল্পের মধ্যমণি না, রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয় উলুখাগড়ার প্রাণ যায়, এখানে আবার রাজা আর চার্চের মধ্যেও ঝামেলার অন্ত নেই। কিন্তু আসল হচ্ছে কিছু সাধারণ মানুষ, তাদের জীবনের গল্প, দূরে কোথাও যে সব বিশাল রাজনৈতিক বা ধর্মীয় পালাবদল ঘটছে সেসব কিংসব্রিজের লোকজনের জীবনে কি প্রভাব ফেলছে, তাদের কাজকর্ম সেই সব বড় ঘটনাতে কি প্রভাব ফেলছে... বইগুলো এই ধারাতে লেখা বলেই আমার আরো একটু গভীরে যেতে ইচ্ছে হয়েছিল। আমি পড়ছিলাম কিংসব্রিজ সিরিজের প্রথম বইটি, The Pillars of the Earth, লেখক বিখ্যাত কেন ফলেট। এটি এই সিরিজের প্রথম বই, যা 12 শতকে ইংল্যান্ডের নৈরাজ্যের সময়কাল নিয়ে লেখা। মূল কাহিনী হলো কিংসব্রিজে, তখনকার একটি ছোট গ্রাম বললেই চলে, সেখানে একজন ক্রিস্টিয়ান পাদ্রীর রাজার সাহায্য ছাড়াই একটি গথিক ক্যাথেড্রাল নির্মাণের প্রচেষ্টা। কাহিনী দারুন জমজমাট, সময়কাল ও দুই জেনারেশন, তৎকালীন রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং মানুষের নানা ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের কাহিনী।
এবার এই সিরিজটা পড়ে আমার মূলত তিনটি আগ্রহ জাগলো, এক হচ্ছে এই যে সব বিশাল বিশাল ক্যাথেড্রাল নির্মিত হয়েছিল, সেগুলো খরচ কি করে তোলা হয়েছিল, আর তৎকালীন চার্চ আর রাজা র মধ্যে কিরকম সম্পর্ক ছিল, আর সবথেকে বেশি আগ্রহ হলো তখনকার সাধারণ মানুষের, জীবনযাত্রা কেমন ছিল?
তার আগে ছোট করে চার্চের পদাধিকারীদের নিয়ে একটু বলে নেওয়া যাক, পোপের কথা তো আমরা জানি, মধ্যযুগের ইংল্যান্ডে যাদের হাতে চার্চের আসল ক্ষমতা ছিল, তারা হলো বিশপ। মোটামুটি বলা যেতে পারে এরা একটা বিশাল এলাকার মধ্যে যত চার্চ, ক্যাথিড্রাল, নানারি, ইত্যাদি আছে তার প্রধান। বিশপদের ওপরে আর্চবিশপ।
এবার মধ্যযুগে চার্চ আর রাজার মধ্যে দ্বন্দ্ব লেগেই থাকত, যদিও বেশিরভাগ সময়েই এই দুপক্ষ মিলেমিশেই চলত, তবে ক্ষমতার একটা দ্বন্দ থাকতোই। এর কারণ শুধু মাত্র চার্চের ধার্মিক ক্ষমতাই নয়, চার্চের টাকাপয়সার জোর ও।
তখনকার চার্চগুলোর হাতে অনেক জমিজমা থাকতো, দান সূত্রে পাওয়া ধনরত্ন থাকতো, তারপরে অনেকসময় কোনো শহর বা গ্রামের শাসন ক্ষমতাও থাকতো বিশপের হাতে।
এই ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং, সাধারণত রাজার নিচের স্থানীয় শাসন নিয়ন্ত্রিত হত ডিউক, আর্ল এদের দ্বারা। এরা রাজনৈতিক এবং সামরিক ভাবে খুবই শক্তিশালী হত, রাজার দরবারে এদের নির্দিষ্ট স্থান থাকতো। কিন্তু অনেক সময়েই বিশপের হাতেও সমান ক্ষমতা থাকত, অর্থাৎ সে শুধু ওই অঞ্চলের চার্চের প্রধান না, রাজনৈতিক প্রধান ও, এদের ও সামরিক বাহিনী থাকতো, রাজার দরবারে স্থান থাকতো। কম্বিনেশনটা ভাবুন, একেবারে নিরংকুশ ক্ষমতা।
তবে রাজার সঙ্গে প্রায়ই লাগতো আর্চবিশপের, তার ফল অনেক সময়েই ভালো হতো না, এই ১২ শতকেই টমাস বেকেট আর দ্বিতীয় হেনরির মধ্যে বিশাল ঝামেলা লাগে, বেকেটের মৃত্যু হয়! এর ফলে হেনরিকে বিশাল ঝামেলা পোহাতে হয়, পোপ তাকে ধর্মচ্যূত করে দেন, অনেক প্রচেষ্টা, নিশ্চয়ই তার মধ্যে অনেক সোনাটোনা মিশে ছিল, হেনরি আবার স্বধর্মে ফিরে আসেন, তবে পাদ্রীদের হাতে (খুবই মোলায়েম ভাবে) বেত্রাঘাত খেয়ে। হেনরি আর বেকেট কিন্তু বন্ধু ছিলেন, সেই জন্যেই হেনরি তাকে আর্চবিশপের পদে সমর্থন দেন, কিন্তু পরে ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে সেই বন্ধুত্ব উবে যেতে সময় লাগে নি। এরকম ঝামেলা পরেও হয়েছে, চার্চের প্রধান মৃত্যুদণ্ড পেয়েছেন।
এবার তখনকার চার্চগুলোর ইনকামের পথ কি ছিল? প্রধান আয় সাধারণ মানুষের ওপরে ট্যাক্স থেকে, চার্চের অনেক জমিজমা থাকতো, সেখানে চাষ করলে ট্যাক্স দিতে হতো, চার্চ গ্রামের জন্যে জায়গা দিত, সেখান বাড়ি বানিয়ে থাকতে হলে ট্যাক্স দিতে হত. এ ছাড়াও পশুপালন থেকে, খনি থেকে, আয় হত, আর আরেকটা পথ ছিল বাজার থেকে, একটা শহরে বাজার বসাতে পারলে সেখানে বাণিজ্যের পথ সুগম হতো, দোকানদারদের কাছ থেকে ট্যাক্স আদায় হত, বাইরের সওদাগরেরা বেচাকেনা করতে আসতো, ট্যাক্স দিত। যেমন এই বইটাতে প্রাইর (Prior) ফিলিপ তার ক্যাথেড্রালে ভেড়া পালন করতো, আর সেই ভেড়ার পশম বিক্রি করে আয় করতো, আবার যারা সেসব কিনতে আসতো তাদেরও ট্যাক্স দিতে হত।
এবারে চার্চের সাধারণ জীবন কি ছিল? মধ্যযুগে অন্তত বেশ টাফ ছিল, মানে সাধারণত। বিশপ বা আর্চবিশপদের কথা আলাদা তো হবেই। সাধারণ ভাবে রাট দুটোয় উঠে একবার প্রার্থনা করতে হত, তিনটে টি ছটা ঘুম তারপর আবার প্রার্থনা, ব্রেকফাস্ট পাউরুটি সঙ্গে জল, বা এল মানে জোলো বিয়ার বলা যেতে পারে, আর সেই পাউরুটি কে হর্স ব্রেড বলা হত, শক্তপোক্ত জিনিস, রাই, যব গম এসব দিয়ে। দুপুরে খাওয়াও তেমন না, অনেক সময়েই নুনে জাড়ানো মাছ বা মাংস, ওয়াইন, সকালে ব্রেকফাস্টের পরে পড়াশোনা, যাদের হাতের লেখা ভালো, তারা বই কপি করত। দুপুরের খাবার পরে খেতে বা খোঁয়াড়ে কাজকর্ম। মানে খাটনি কম ছিল না।
এবারে আরেকটা বিষয় ছিল, এই সব বিশপেরা, যারা আর্চ বিশপ হতো, প্রিন্স বিশপ ( যারা শহর শাসন ক্ষমতা পেত) তাদের খুঁটির জোর লাগতো। তার প্রথম এবং প্রধান চাহিদা হলো বংশ, নোবলিটি বা অভিজাত বংশের ছেলেদের এইসব পদ পাওয়া সহজ হতো, অবশ্যি যদি সেই ফ্যামিলি রাজার গুড বুকে থাকতো।
এখন এইসব বড় বংশের ছেলেরা কেন এই কষ্টকর চার্চের জীবনে যোগ দিত? এর নানা কারণ ছিল, প্রধান হচ্ছে ক্ষমতা, চার্চে যোগ দিয়ে উঁচু পদে উঠে অনেক ক্ষমতা লাভ করা সম্ভব ছিল, আর এইসব বড় বংশের ছেলেরা চার্চে অত কষ্ট করতো না, কারণ তাদের পরিবার ভালোই যাকে বলে সিধে পাঠাতো। বংশে একাধিক ছেলে থাকলে, বড় পুত্রই বাবার টাইটেল পেত, অর্থাৎ ডিউক বা আর্ল এবং জমিদারিও । তাই পরের ছেলের পক্ষে দুটো চান্স থাকতো, এক হচ্ছে নাইট হয়ে লড়ে ধনসম্পত্তির মালিক হওয়া বা চার্চে যোগ দেওয়া। অবশ্যই অনেকে নিছক ধর্মের প্রতি আসক্তি থেকেও যোগ দিত, বা স্কলার মনোবৃত্তির হলে, কারণ তখন পড়াশোনা কেবল মাত্র চার্চে যোগ দিলেই ঠিকঠাক করা যেত, বাইরে থাকলে অন্নচিন্তা।
সাধারণ মানুষ? কষ্টের জীবন। রোম সাম্রাজ্যের পতনের পরে রোমানরা ইংল্যান্ড ছেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেখানকার লোকেরা যেন অন্ধকার যুগে ফিরে যায়। বাড়ি বানানোর জন্যে রোমান আর্কিটেকচার, জিনিসপত্র রাখার জন্যে বড় পাত্র তৈরির পটারির কার্য কৌশল,সব সূক্ষ্ণ জিনিস যেন ভুলে যায়. অবশ্য রোমানরা হয়তো স্থানীয়দের শেখায় ও নি, এসব সাম্রাজ্যের অন্য অংশ থেকে আসত। যাই হোক পরের দিকে প্রায় পাঁচ সাতশো বছর সাধারণ লোকের থাকার জায়গা হতো সাধারণত একটাই বড় ঘর, ওক কাঠের ফ্রেম, দেয়াল, মাটির মেঝে, ছাদে খড়, মেঝেতে নলখাগড়া বা খড় বেছানো, ঘরের মাঝে একটা বড় আগুন জ্বালানোর জায়গা, রাতে সেটাই বাতির কাজ করতো, রান্না হত, শীতের সময়ে উষ্ণতা দিত। ঘরে প্রায়ই জানালা থাকতো না, ঘুলঘুলি টাইপ ফাঁক থাকত।
এবার একটাই ঘরে গোটা ফ্যামিলি থাকার মানে, জীবনের যে সব কাজের জন্যে আড়াল আবডাল লাগে, তা কেবল অন্ধকার দিয়ে ঢাকা থাকতো।
বড়লোকদের অবশ্য এমন হতো না, তবে এমন কি কাসলেও ডিউক আর তার ফ্যামিলির জন্যে আলাদা ঘর থাকলেও, চাকরবাকর রা সাধারণত, যে বড় হলে দিনের বেলাতে ডিউকের সভা বসতো সেখানেই রাতে ঘুমোতো।
অথচ এই সময়ের ওখানকার মানুষেরা তৈরি করছিল বিশাল বিশাল চার্চ, ব্যাসিলিকা,ক্যাথেড্রাল, কাসল, প্যালেস। অবশ্য এই জিনিস গোটা পৃথিবীতেই মধ্যযুগে দেখা যায়।
এই সাধারণ মানুষেরাই ছিল চার্চের আসল ক্ষমতা। আরো ভালো করে বললে পাপের ভয় আর মরার পরে আত্মার সদ্গতি না হওয়া। এটা কেবল ইংল্যান্ডের বা শুধু মধ্যযুগের জিনিস না। তবে ওই সময়ে এর প্রকোপ ছিল অত্যন্ত বেশি। সাধারণ মানুষের কাছে রাজাটাজা একটা আবছা কনসেপ্ট মাত্র ছিল তখন, একজন কেও কোথাও সিংহাসনে বসে আছে... কিন্তু আসলে সামনের চার্চই তার জীবনকে কন্ট্রোল করত।
আশ্চর্য হবার কিছু নেই যে রাজা আর চার্চের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব লেগেই থাকত।
প্রথমে বলেছিলাম, যে ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করছি, যা বললাম সে কেবল আমার পল্লবগ্রাহিতার ফল, এসব অবশ্যই ভালো নন ফিক্শন পড়ে গভীরভাবে জানা যাবে, তবে এই লেখকের ফিক্শন গুলো পড়লেও ৯০০ থেকে ১৮০০ পর্যন্ত ইংল্যান্ডের রাজনীতি আর ধর্মের যুগলবন্দী, দ্বন্দ্ব আর মাঝে সাধারণ মানুষের জীবন খুব ভালো বোঝা যায়। কারণ লেখক এই সব তথ্য নিয়েই নির্মাণ করেছেন সাধারণ মানুষের কষ্ট, খুশি, প্রেম, ভালোবাসা, ত্যাগ অকৃতজ্ঞতা! আর ভালো ড্রামাটাইজেশনের থেকে সুস্বাদু আর কি হতে পারে ?
সিরিজ পড়তে চাইলে এই অর্ডারে পড়বেন, সবগুলোই এক দুই শতাব্দী পরে পরে কিংসব্রিজ গ্রামটার অধিবাসীদের গল্প, তাদের জীবনের আর তার সঙ্গে ইংল্যান্ডের তখনকার সমাজ, রাজনীতির উত্থানপতনের গল্প।
The Evening and the Morning ( এটা প্রিকোয়েল, The Pillars of the Earth আগে লেখা হয়েছিল, তবে এটা থেকে শুরু করলে ভালো লাগবে)
The Pillars of the Earth
World Without End
A Column of Fire
The Armour of Light
প্রতি পূর্নিমার মধ্যরাতে একবার
আকাশের দিকে তাকাই।
গৃহত্যাগী হবার মত জোছনা কি উঠেছে?
বালিকা ভুলানো জোছনা নয়,
যে জোছনায় বালিকারা ছাদের
রেলিং ধরে ছুটোছুটি করতে করতে বলবে,
ও মাগো! কি সুন্দর চাঁদ!
নব দম্পতির জোছনাও নয়,
যে জোছনা দেখে স্বামী গাঢ়
স্বরে স্ত্রীকে বলবে;
দেখো দেখো,
চাঁদটা তোমার মুখের মতই সুন্দর।
কাজলা দিদির স্যাঁতস্যাঁতে
জোছনা নয়,
যে জোছনা বাসি স্মৃতিপূর্ণ ডাস্টবিন উল্টে দেয় আকাশে।
কবির জোছনা নয়,
যে জোছনা দেখে কবি বলবেন,
কি আশ্চর্য রুপোর থালার মত চাঁদ।
আমি সিদ্ধার্থের মত
গৃহত্যাগী জোছনার জন্য বসে আছি।
যে জোছনা দেখা মাত্র গৃহের সমস্ত
দরজা খুলে যাবে।
ঘরের ভেতর
ঢুকে পড়বে বিস্তৃত প্রান্তর।
প্রান্তরে হাঁটব, হাঁটব, আর হাঁটব।
পূর্নিমার চাঁদ স্থির হয়ে থাকবে মধ্য আকাশে,
চারিদিক থেকে বিবিধ কন্ঠ
ডাকবে … আয়, আয়, আয় ।।
-(গৃহত্যাগী জোছনা – হুমায়ূন আহমেদ)
গৃহত্যাগী হবার মতন জোছনা কি সত্যিই ওঠে আকাশে ? সবাই কি সে জোছনার স্পর্শ পায় ? বুদ্ধ যেমন পেয়েছিলেন ? গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাসের পথে যাত্রা করা পৃথিবীতে নতুন কিছু না , ভারতবর্ষে তো একদমই না ! যারা ঘর ছেড়ে বেরোন তারা যে কিসের টানে বেরোন তা বলা কঠিন , নারায়ণ সান্যাল পয়োমুখমে এক চরিত্রকে দিয়ে বলিয়েছেন:
- সংসারত্যাগী সাধু কারা হয় ? চারপ্রকার লোকে হয়,
যারা জন্ম মুমুক্ষ, বুদ্ধ বা চৈতন্যের মতন !
যারা কোনো বাঁধনেই বাঁধা থাকতে চায় না, অতিথি গল্পের তারাপদর মতন , এরা বারে বারে পালিয়ে যায় আর শেষপর্যন্ত এক বড় অংশ সাধু হয়ে যায় !
যারা সংসারের ধাক্কা খেয়ে বেরিয়ে আসে, পরিজনের মৃত্যু, প্রেমে ব্যর্থতা, জীবনযুদ্ধে হেরে যাওয়া, এরা অনেকে একপ্রকার শান্তি পায় !
আর আরেকপ্রকার হলো দায়িত্ব না নিতে চাওয়া পরের মাথায় কাঁটাল ভেঙে খাওয়া লোকজন ! তা এই শেষ প্রকারের জীবগুলো আবার অনেক সময় তমোগুণের থেকেও নিচু মানসিকতার হয়, কাগজে এদের কথা প্রায়ই বার হয়, আর সাধারণ লোকে আমাদের হিঁদুশাস্ত্রের সনাতন কাল থেকে চলে আসা middleman এর ধরে কিছু বাগিয়ে নেওয়ার লোভও ছাড়তে পারে না । তবে এদের কথা আজ থাক।
কিন্তু গৃহ ত্যাগ কি একান্ত দরকার? রামকৃষ্ণ যেমন বলে গেছেন, কলিকালে অন্নগত প্রাণ, গৃহদুর্গ ই সবচেয়ে ভালো, ধ্যান করবে মনে বনে আর কোণে ইত্যাদি অর্থাৎ ঘরবাড়ি পরিজনকে ছেড়ে বিবাগী না হয়েও আধ্যাত্মিকতার পথে যাওয়া যায় সেরকম দৃষ্টান্তেরও অভাব নেই এই ভারতে! এরকম লোকেদের আবার সবসময় চেনা যায় না, গুপ্তযোগী !
তা আমার হাতেকলমে অভিজ্ঞতার ঝুলি তো শূন্য। কিন্তু এই ব্যাপারে দুটো বইয়ের কথা বলতে পারি , প্রথমটি হলো Nine Lives by William Dalrymple, যদি বইটি ইতোমধ্যেই পড়ে থাকেন তবে জানবেন যে এইরকম ঘর ছেড়ে বার হয়ে যাওয়া আজও থামেনি, এবং কারণগুলোও একই রকম আছে , আবার অবশ্যই সবাই ঘর ছেড়েও বেরোয়নি, সেই ট্রাডিশনও একই আছে। বইটার এই নয়জনের জীবন আমাদের উপমহাদেশের আধ্যাত্মিকতার এখনো চলমান ধারার একটা সামগ্রিক চিত্র ভালোই বুঝিয়ে দেয় ! এই নয়জনের কথা একটু বলি , এরকম চরিত্রের হয়তো খুব একটা অভাব নেই, আমরা অনেকেই কাছেপিঠে এইধরনের চরিত্রের দেখা সাক্ষাৎ পেয়ে থাকি, কিন্তু কোথাও গিয়ে এরা আলাদা হয়ে যান।
-জৈন সন্ন্যাসিনী : প্রাচীন তীর্থ নগরী শ্রাবণবেলাগোলাতে এই সন্ন্যাসিনী প্রাচীন জৈন মতে উপবাস করে দেহত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন , কিন্তু তার এই পথে আসার পেছনের কাহিনী আসলে কি ?
-কান্নুর নৃত্যশিল্পী: কেরালার এক দলিত হরি দাসের গল্প, যিনি কারাগারের রক্ষী হিসেবে কাজ করেন। কেবল ডিসেম্বরের থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পবিত্র থিয়ামের মরসুমে তিনি এক ঐশ্বরিক নৃত্যশিল্পী হয়ে ওঠেন যার পায়ে হাত দিতে উচ্চ বর্ণের ব্রাহ্মণরাও এগিয়ে আসেন ।
-ইল্লাম্মার কন্যা: কর্ণাটকের বেলগাঁওয়ের দেবদাসী রানী বাইয়ের গল্প, তিনি 6 বছর বয়সে বাবা-মা দ্বারা ভারতের এক প্রাচীনতম পেশায় উত্সর্গীকৃত, কীভাবে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই পেশার পরিবর্তন ও অভিযোজন হয়েছে এবং সেই দেবদাসীদের দেবীইল্লামার কাহিনী ! তিনি কি নেমে আসেন তার কন্যাদের মধ্যে?
-রাজস্থানের গায়ক জুটি : মোহন ভোপা এবং তাঁর স্ত্রী বাতাসির গল্প, রাজস্থানী মধ্যযুগীয় কবিতার শেষ বংশগত গায়ক দুজন। কিন্তু তাদের জীবনদর্শন অবাক করার মতন !
-লাল পরীর গল্প: ভারত বিহার রাজ্যের এক মুসলিম মহিলা লালপরীর গল্প, যিনি পাকিস্তানের পল্লী সিন্ধুতে লাল শাহবাজ ক্যালান্দারের সুফি দরগাহকে নিজের বাড়িতে পরিণত করেছেন। আর রয়েছেন ধর্মনিরপেক্ষ সুফিবাদের সাথে গোঁড়া ইসলামের চলমান বিরোধের মধ্যে।
- তিব্বতি সন্ন্যাসীদের কাহিনী: মূলত তিব্বতের তাসি পাসাংগের গল্প, যে চীনারা তিব্বতকে দখল করার পরে এখন ভারতের ধর্মশালায় বসবাস করছে। চিনের বিরুদ্ধে তিব্বতিয়ান প্রতিরোধের জন্যে একজন সন্ন্যাসীর পক্ষে অস্ত্র হাতে নেওয়া কি সোজা ব্যাপার? কিন্তু তার পেছনের কাহিনী কি ?
-মূর্তি নির্মাতা শ্রীকান্ত স্থপতির গল্প: তামিলনাড়ুর মন্দিরের শহর স্বামীমালায়ের এক বংশানুক্রমিক স্থপতি যার পূর্বপুরুষেরা চোল সাম্রাজ্যের দুর্দান্ত ভাস্কর্যগুলির জনক ! এই দীর্ঘ বংশানুক্রমিক যাত্রা কি তার মধ্যে অন্য এক অনুভূতির জন্ম দিয়েছে ?
-ভৈরবীর গল্প: পশ্চিমবঙ্গের পবিত্র শহর তারাপীঠে বসবাসকারী এবং মা তারার উপাসিকা মনীষা মা ভৈরবীর গল্প।
-অন্ধ বাউল : কানাই দাস ও দেবদাস বাউলের গল্প , প্রথামত বাউলের গায়কের ঐতিহ্য বহন করে বেড়াচ্ছেন যারা , তাদের উপলব্ধির গল্প !
ডালরিম্পলের বইটি বেশ পুরোনো ! ২০০৯ সালের ! অনেক দিন আগেই পড়া, কিন্তু সম্প্রতি আরেকটা সম্পূর্ণ বিপরীত বই পড়ে এই বইটির কথাও আবার নতুন করে মনে পড়ে গেলো ! এই বইটির নাম দীর্ঘ , Single White MonkTales of Death, Failure, and Bad Sex (Although Not Necessarily in That Order) By Shozan Jack Haubner!
নাম দেখে আগ্রহ জাগলেও এইটা আবার টিপিক্যাল আমেরিকান খিল্লি বই কিনা তা নিয়ে সন্দেহ ছিল, তাই এদিক ওদিক থেকে একটু তথ্য জোগাড় করে তারপর পড়তে শুরু করেছিলাম ! বইটি জেন ধর্মমতের একজন সন্ন্যাসীর লেখা , ভারতে এই মতের অনুসারী আছে কিনা জানা নেই , কিন্তু জেন পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন ধর্মমত তাতো জানেনই !
আধ্যাত্মিকতার সাথে হাস্যরসের মিশেল কিরকম হয় ? সন্ন্যাসী কি ´নিজের মধ্যের যে টানাপোড়েন, সে শুধু আধ্যাত্মিক থিওরিটিক্যাল সমস্যা না , বাস্তবের কামনা বাসনার সঙ্গে হররোজ যে লড়াই চলে তা কি নির্মোহ ভাবে প্রকাশ করার সাহস দেখাতে পারেন? পারেন না আসলে, সমাজ তাহলে তাকে অন্য স্তরের মনে করবে না, সন্ন্যাসী হবেন এক মহত্তর মানুষ , কি করে হল তার উত্তরণ তা লোকে ভক্তিভরে পড়বে, অর্থাৎ তপস্যা ইত্যাদি, ইন্দ্রিয়জ কামনাবাসনার সঙ্গে লড়াই ও জানতে চাইবে! এই সন্ন্যাসীও প্রকাশ করার জন্যে ছদ্মনামের আশ্রয় নিয়েছেন !
Shozan Jack Haubner আসল নাম নয়, কিন্তু যিনি লিখেছেন তিনি প্রকৃতই জেন সন্ন্যাসী ! তার পূর্বজীবনে তিনি নিজেকে চিহ্নিত করেন আমেরিকার মধ্য-পশ্চিমাঞ্চলের এক মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হিসেবে , যার বাবার আচরণ বেশিরভাগ সময়েই ক্রুদ্ধ মেল গিবসনের সাথে মিলে যায় ! তার পারিবারিক জীবনের নানারকম ঘটনা তাকে সন্ন্যাসী হবার দিকে প্ররোচনা দিয়েছিলো ! কিন্তু মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে "আমি সন্ন্যাসী হবো ! " এই ঘোষণা করলে কি ঝড় বয়ে যায় সেখান থেকেই শুরু হয় তার সন্ন্যাসী জীবনের যাত্রা ! প্যানক্রিয়াটাইটিসজনিত প্রায় মৃত্যুমুখে পতন থেকে তাঁর প্রিয় বন্ধুর মৃত্যুর ঘটনা তার জীবনকে অন্যরকম ভাবে দেখতে শেখায়, কিন্ত সে জীবনটা সাধারণ জীবন না , তার সন্ন্যাসী জীবন ! এই সব কিছুর সাথে যোগ হয় মঠের অভ্যন্তরের নানা ঘটনা যা প্রায় তাদের সংঘের অস্তিত্বই মুছে দিচ্ছিলো ! বাইরের মানুষ যা ভাবে সন্ন্যাসী জীবন কি আসলেই সেরকম ? নাকি আসলে তা সমস্যার পর সমস্যার মুখোমুখি হওয়া এবং সে সব সমস্যা স্পিরিচুয়াল কিছু নয় মোটেই?
এইরকম অভিজ্ঞতা মানুষকে তিতকুটে করে তোলে, কিন্তু এই সন্ন্যাসী নিলেন তার বিপরীত পথ, হাস্যরস ! নিজেকে, নিজের জীবনের নানা ঘটনাকে আর সমস্যাকে জেন দর্শন দিয়ে মোকাবিলা করার চেষ্টা করলেন খানিকটা হাস্যরস মিশিয়ে দিয়ে , এই হলো তার অস্ত্র ! এই ককটেল দিয়ে জীবনে আসা যৌন প্রণোদনা থেকে ডিস্কো পার্টিতে যাবার ইচ্ছে , এই সবকিছুকে কি সামলানো যায় ? বইতে রয়েছে তারই চেষ্টার বিবরণ, পড়ে পাঠক হাসবেন! হয়তো সেটাই লেখকের আপাত ইচ্ছে , কিন্তু যে সন্ন্যাসী জীবনে হিউমারকে দূরে সরিয়ে দেন না তার আসল মনোভাবের তল পাওয়া কি সহজ হবে ? বইটা পড়ে কার কেমন লাগবে তার ধারণা করা আমার পক্ষে সম্ভব না, তবে সন্ন্যাসী জীবনকে অন্যদিকে দিয়ে দেখার এই প্রচেষ্টা আমার তো আলাদারকম ভালো লেগেছে !
সিন্ধু সভ্যতার অগ্নি পূজা ও বৈদিক যজ্ঞ - একটি তুলনামূলক আলোচনা
লেখক : দীপান ভট্টাচার্য / প্রকাশক : বাংলার মুখ / মূল্য : ৪৫০ টাকা
--------------
সিন্ধুসভ্যতার 'দিকে চাহিয়া আমাদের বিস্ময়ের অন্ত নেই ' . কারণ ও সহজবোধ্য। ওই অত হাজার বছর আগে এরকম সুবিন্যস্ত নাগরিক সভ্যতা, যা আজকের হিসেবেও অত্যন্ত আধুনিক, বিশাল ইঁটের তৈরী শহর, দুর্গ , নিকাশি ব্যবস্থা, জঞ্জাল অপসারণ , তারপর ব্যবসা বাণিজ্য এবং শিল্পের উন্নতি। শিল্পের উন্নতি ব্যাপারটা মাথায় রাখা দরকার। কারণ এই সভ্যতার কালসীমা মধ্য প্রস্তর যুগের হান্টার গ্যাদারার পর্যায় থেকে শুরু। সেখান থেকে এই সভ্যতাতে বিশাল বড় বড় চুল্লি পাওয়া গেছে যা মাস প্রডাকশনের নমুনা।
এবার চলে আসি বৈদিক সভ্যতাতে। সঙ্গে সঙ্গে ঢুকে পড়বে সেই বিশাল আলোচনা। এই দুই সভ্যতার মধ্যে কি কোনো সংযোগ আছে ? এ নিয়ে অনেক তত্ত্বের অবতারণা করা হয়েছে , কেউ বলেন যে আর্যরাই সিন্ধুসভ্যতার পতনের জন্যে পুরোপুরি দায়ী, কেউ বলে খরাটাই মূল কারণ, কেউ বলে খরা তো ছিলই কিন্তু আর্য আক্রমণ ও তাতে ইন্ধন জুগিয়েছিল ইত্যাদি, প্রভৃতি।
আবার কেউ বলেন, সিন্ধু সভ্যতা থেকেই পরবর্তী কালে বৈদিক সভ্যতা আসে, তাহলে প্রশ্ন আসে যে সিন্ধু সভ্যতার অত বিশাল শহুরে সভ্যতা কি করে বৈদিক সভ্যতার গ্রাম ভিত্তিক সভ্যতাতে পরিণত হলো ? কেউ এর স্বপক্ষে বলবেন, ব্রিটেনের কথা। রোমানরা সেখানে শহর গড়েছিল, তাদের পতনের পরের বহুদিন ব্রিটেন গ্রাম ভিত্তিক সভ্যতাই ছিল, কারণ রোমানদের মতন বিশাল ক্ষমতা আর অর্থ তাদের ছিল না। এ ক্ষেত্রেও সেরকম হতে পারে।
এই সব তত্ত্ব থেকে যেটা বোঝা যায় তা হলো, এই দুই সভ্যতার মধ্যে মিসিং লিংক এখনো মিসিং। এই বইটি সেই মিসিং লিংক খোঁজার একটি প্রচেষ্টা।
এইবার এই বইটির লেখক মশাই হলেন মূলত পাথুরে গোয়েন্দা। তাই ইনি একটা অভিনব ক্ষেত্রকে বেছে নিলেন এর জন্যে ।
আচ্ছা বৈদিক সভ্যতা বলতে আপনার প্রথমেই কি মনে আসে ?
বেদ বেদাঙ্গ, উপনিষদ!
তারপর ?
যাগযজ্ঞ!
হ্যাঁ , প্রাচীন বৈদিক সাহিত্য যাগযজ্ঞের বর্ণনাতে ভরপুর।
এবার সিন্ধু সভ্যতাতেও প্রচুর আগুন জ্বালানোর চিহ্ন পাওয়া যায়। সেগুলো কি অগ্নি উপাসনার জন্যে ? এই দুই সভ্যতার মধ্যে যদি কিছু যোগসূত্র থেকে থাকে তাহলে এখানেও পাওয়া যেতে পারে। সিন্ধু সভ্যতা পূর্বজ হলেও তুলনা করলে কিছু না কিছু মিল তো থাকবেই।
এই তুলনাটা কি করে করা যাবে ? এখানেই প্রথম অসুবিধা। বৈদিক যজ্ঞের পাথুরে প্রমান প্রায় নেই। কিন্তু বেদে এবং আনুষঙ্গিক সাহিত্যে যজ্ঞের ভালো বর্ণনা পাওয়া যায়। মানে একেবারে স্টেপ বাই স্টেপ কোন যজ্ঞ কি করে করতে হবে , তার জন্যে যজ্ঞ বেদি কটা লাগবে , কতবড় হবে, কি আকারের হবে , কটা ইঁট লাগবে, সেই ইঁটের আকার কেমন হবে , ইত্যাদি পুঙ্খানুপুঙ্খু বিবরণ আছে।
আবার সিন্ধুসভ্যতাতে সমস্যা হলো, সেটা একেবারে মূক. আমরা তো তার লিপিই পড়তে পারিনি। কিন্তু পাথুরে প্রমান অনেক।
কিন্তু যে সভ্যতা একেবারে মুখ বুজে আছে সেখানে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন কে পাথুরে প্রমাণের পর্য্যায়ে নিয়ে যেতে হলে অনেক সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়।
এখন একটা ভালো নন ফিকশন বইয়ে লেখক স্রেফ নিজের আন্দাজ আর মতবাদ পাঠকের ওপরে চাপিয়ে দিতে পারেন না , তাঁকে সেগুলো ব্যাখ্যা করতে হবে। সেখানে সমস্যা হলো যে এইসব ব্যাখ্যা আবার অনেক সময়েই খুব ই একাডেমিক আর বোরিং হয়ে যায় আমার মতন সাধারণ পাঠকের কাছে।
এই বইটি হয়নি। কারণ দুটি, প্রথমটি হলো লেখক আগে পাঠকের বোঝার জন্যে ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছেন, কিন্তু ইনফো ডাম্প বা জ্ঞান দেন নি , আর দ্বিতীয়ত , আরো গুরুত্বপূর্ন , তিনি খুব পরিষ্কার ভাবে বলে দিয়েছেন কিভাবে তিনি এই তুলনা টানছেন।
কিভাবে টানছেন ? না প্রথমেই বৈদিক সভ্যতা, অর্থাৎ বেদ, উপনিষদ থেকে বিভিন্ন যজ্ঞ এবং তার খুঁটিনাটির একটা সুন্দর বিবরণ দিয়েছেন , এর পরে সিন্ধু সভ্যতার সম্পর্কে , সেখানে পাওয়া নানা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সম্পর্কে বলেছেন, এবং তার পরে প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ সিন্ধু সভ্যতার জায়গা যেমন কালিবঙ্গান, লোথাল, রাখিগড়ি ইত্যাদি ধরে ধরে তুলনাটা করেছেন। তুলনা করার প্রধান ক্ষেত্রগুলো হলো, সিন্ধু সভ্যতাতে অগ্নিপূজক ছিল কিনা, যে আগুন জ্বালানোর জায়গাগুলো পাওয়া গেছে সেগুলো আসলে কি ? শিল্পের জন্যে তৈরী চুল্লি না যজ্ঞবেদী ? তারপরে বৈদিক সভ্যতার যজ্ঞের সঙ্গে তুলনা।
এর ফল আমার কাছে অন্তত অসামান্য হয়েছে। প্রথমত বৈদিক সভ্যতা সম্পর্কে আমার ছাড়া ছাড়া জ্ঞান একটু হালে পানি পেয়েছে , বেদের অনেক ভাগ আছে, উপনিষদ বলে অনেক বই আছে, বৈদিক কালে রাজসূয় অশ্বমেধ ইত্যাদি নানা যজ্ঞ হতো, আমার এই রকম জ্ঞান থেকে যাকে বলে একটা সুষম জানাশোনা হলো, এত রকম যজ্ঞ যে হতো, তাই তো জানতুম না , আর বেদের খুঁটিনাটি সম্পর্কে না হয় নাই বললাম।
একই কথা প্রযোজ্য সিন্ধু সভ্যতা সম্পর্কে। এই সভ্যতার শহর, শহরের গঠন, সেগুলোর ধ্বংস এবং পুনর্গঠন , সভ্যতার বিস্তার , এসব সম্পর্কে একটা পরিষ্কার ধারণা দিয়েছেন, আর পাঠকের মনে এনেছেন নানা জিজ্ঞাসা। এতো বিস্তৃত এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা সভ্যতার বিভিন্ন শহরের বসতির মধ্যে এমন একটা সাযুজ্য পাওয়া গেছে যা থেকে চিন্তা আসে, একটা কমন রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ না থাকলে কি তা সম্ভব হতো ? দুঃখের কথা তা জানার কোনো উপায় নেই। অন্তত এখনো পর্যন্ত্য।
কিন্তু এই ঝরঝরে ভাষায় বইটি থেকে যা জানা গেলো আমার কাছে সেটাও মূল্যও অপরিসীম। বাংলায় এমন লেখা লেখার জন্যে লেখকমশাইকে সাধুবাদ ও ধন্যবাদ।
The Wandering Earth by Cixin Liu, ₹151.87 (Kindle)
Project Hail Mary: by Andy Weir ₹329.93 (Kindle)
যারা কল্পবিজ্ঞান পড়েন তাদের কাছের ওপরের দুজন লেখক ই পরিচিত হবেন। এই দুটো বইয়ের মধ্যে একটা সাধারণ সাদৃশ্য আছে, দুটি বইই যাকে বলে ডুমসডের ওপরে এবং দুটোতেই সমস্যার কারণ সূর্য। কিন্তু আসলে কাহিনীতে কোনোই মিল নেই।
লিউ এর বইয়ে সূর্য নিভে যাচ্ছে, মানে পৃথিবী তখন আমাদের সময় থেকে মিলিয়ন মিলিয়ন বছর পরের। আর তার মানে টেকনোলোজিক্যাল এডভান্সমেন্ট তখন তুঙ্গে। সূর্য নিভে যাচ্ছে তার জ্বালানি শেষ হয়ে যাচ্ছে বলে। মানুষ ঠিক করেছে তারা সোলার সিস্টেম ছেড়ে চলে যাবে , কিন্তু কিসে করে যাবে? মহাকাশ যান সম্ভব না , কোটি কোটি না হলেও লক্ষ লক্ষ মানুযকে নিয়ে যাওয়াও সম্ভব না। কারণ জার্নি টা এক দু বছরের না, হাজার বছরের। আমাদের সব থেকে কাছের তারাতে যেতে ওরকম ই সময় লাগবে। তো মানুষ ঠিক করেছে গোটা পৃথিবীটাকেই নিয়ে যাবে। হ্যাবিট্যাট টাও থাকবে সাথে, পরে আবার ঠিকঠাক করে নেওয়া যাবে আর কি।
এখন ভাবুন পৃথিবীকে যদি তার কক্ষপথ থেকে বার করে নিতে হয় তাহলে কি কি করতে হবে? প্রথমেই তার ঘূর্ণন বন্ধ করতে হবে, তারপরে তো যাত্রা, এ সবের ব্যবস্থা হয়েছে, ঘূর্ণন বন্ধ হলে পরিবেশের বারোটা বাজবে, তারপর যেই জার্নি শুরু হবে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল হওয়া হয়ে যাবে। মানে মাটির ওপরে আর বাস করা সম্ভব না। তাই মানুষ বাস করছে মাটির নিচে , শহর গড়ে।
এসব তো হলো ! এবার যতই উন্নত সভ্যতা হোক, মানুষের প্রবৃত্তির কিরকম পরিবর্তন হবে আজ থেকে মিলিয়ন বছর পরে ? তারা কি লজিকাল হবে , নাকি আগেকার মতনই ইমোশনাল, বোকা আর অকৃতজ্ঞ থাকবে? এই লম্বা যাত্রার শুরু হবার পরেই তার প্রমান পাওয়া যায়। বিজ্ঞানীরা, যারা অক্লান্ত পরিশ্রম করে সমস্ত কিছু করেন, তারা মুখোমুখি হন একদল কৃতঘ্ন মানুষের। শেষ পর্যন্ত কি হয় আর এই হাজার বছরের যাত্রার শেষে যে এই এতো বছর ধরে কতগুলো প্রজন্ম এই চলমান পৃথিবীতে জন্মাবে , বড় হবে তারা কিভাবে বিকশিত হবে কে জানে - এই চিন্তাতেই শেষ এই বই।
বেশি বড় গল্প না। হার্ড সায়েন্স ফিকশন কি? এটিকে হয়তো ততটা হার্ড সায়েন্স ফিক্শaন ও বলবো না, মানুষের চরিত্রায়ন একটা বড় ব্যাপার বইটাতে , সে জন্যেই হয়তো এটা পড়ার রেশ থেকে যায় সারাজীবন ধরে।
এবার পরের বইটা - এটাতেও সমস্যা সূর্যকে নিয়ে, কিন্তু সে এক অদ্ভুত ব্যাপার , সূর্য আর শুক্র গ্রহের মধ্যে এসে হাজির হয়েছে এক অণুজীব। জীবই, তবে এদের খাদ্য হচ্ছে এনার্জি , আর এরা সেই শক্তি আহরণ করছে সূর্য থেকে , ফল? সূর্যের তেজ কমে যাওয়া। পৃথিবীর উষ্ণতা কমে যাওয়া, আইস এজ আসা। আর এসব ঘটছে বর্তমান কালে। অর্থাৎ আমাদের কাছে এমন কোনো টেকনোলজি নেই যাতে করে আমরা সবাই পালিয়ে যেতে পারি।
এটা একেবারেই হার্ড সায়েন্স ফিকশন, তার কারণ হচ্ছে যা যা ঘটছে তার বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা দেওয়া আছে, অর্থাৎ ষ্টার ট্রেকের মতন বিম মি স্কটি , বলেই থেমে যান নি লেখক, কি করে তা করা যেতে পারে তার বর্ণনা আছে। আর আছে এর এন্টিডোট কি হতে পারে সেসবের রহস্য সমাধান, সেও কম বিগ্গণের থিওরি না। আর সে জন্যেই এটা মাঝে মাঝে বিজ্ঞানের পাঠ্য বই টাইপ মনে হতে পারে। কিন্তু তার দরকার ছিল, আমার স্কুলে পড়া বায়োলজির জ্ঞান, তার সঙ্গে পরিবেশ, স্পেস সায়েন্স এইসবের হালকা জ্ঞানই যথেষ্ট সেসব কে বুঝতে - আর এর সঙ্গে আছে লম্বা স্পেস ট্রাভেল আর ভিনগ্রহীর সাথে মোলাকাত।
এখন পর্যন্ত ভিনগ্রহীদের সাথে মোলাকাতের যেসব গল্প পড়েছেন তা কেমন? বেশিরভাগই কলোনি বানাতে আসছে। স্বাভাবিক। মানুষ নিজের পরিচিত গন্ডি ছেড়ে কেবলমাত্র কলোনি বানাতেই তো বেরিয়েছিল আর তার ফল রক্তারক্তি। তাই সুদূর গ্যালাক্সি থেকে যারা আসবে তারা আর কি উদ্দেশ্যে আসবে? এখন বলতে পারেন , কেন? বিজ্ঞানের নামেও আসতে পারে। অজানাকে জানতে বিজ্ঞানসম্মত অভিযান। মানুষ ও অজানাকে জানতে অভিযান করেনি ? করেছে। কিন্তু তার পেছনে কারা টাকা ঢেলেছে ? রাজনৈতিক শক্তি , আর তাদের আসল উদ্দেশ্য কি ? এখানেও স্পেস ট্রাভেল করে মানুষ পৃথিবীকে বাঁচানোর জন্যে, ওই শক্তিখেকো অণুজীবের এন্টিডোট খোঁজার জন্যে, খানিকটা হনুমানের বিশল্যকরণী খোঁজার জন্যে। আর এই অণুজীব তো আরো অনেক তারাকেও খাচ্ছে, তো তাদের আশেপাশে যদি জীব থাকে তো তাদের ও সেই এন্টিডোট দরকার।
এভাবেই দেখা হয়ে যায় মানুষ আর এলিয়েনের। কিন্তু মনে রাখতে হবে দুই পক্ষেই আছে বিজ্ঞানী। তারা কেউ ই রাজনৈতিক মতলববাজ না। তাদের আগ্রহ সত্যিই অজানাকে জানার। তাই এই মোলাকাত যুধ্ধং দেহি ভাবে হয় না। দুই পক্ষের বিজ্ঞানীর আগ্রহ অপরপক্ষকে জানার বোঝার, মনে রাখতে হবে যদি এরকম দুই এলিয়েন সভ্যতার দেখা হয়, তাদের টেকনোলজি একে ওপরের থেকে বিশাল কিছু উন্নত হবে না, মোটামুটি সমান লেভেলের হবে। কারণ কম উন্নত হলে তো তারা স্পেস ট্রাভেল করতেই পারবে না, আর খুব বেশি উন্নত হলে হয়তো তাদের নিজেদের গ্রহের বাইরে যাবার দরকারই পড়বে না। কিন্তু সমান লেভেলের মানে বিজ্ঞানের মূল তত্ত্বের জ্ঞান একরকম, কিন্তু তা বলে টেকনোলোজি কি এক হবে ? আর জীব হিসেবেও কি তারা একই রকম হবে ? না। সেটাই তো জানার।
এই গল্পটার মজা হচ্ছে নানা টুইস্ট। একেবারে শেষ পর্যন্ত। তবে সেসব আছে হার্ড সায়েন্টিফিক ইনফরমেশনের মধ্যে।
তবে তাতে মূল গল্পের আকর্ষণ কমে না। গল্পের বিস্তৃতি, চরিত্রগুলোর গভীরতা আর শেষ পর্যন্ত একটা আশ্চর্য বন্ধুত্বের কাহিনী এটা। হওয়ার ই কথা , কারণ এই লেখকের প্রথম বইটা হলো - দি মার্শিয়ান - চেনা লাগছে ?
এই দুটো বইই একসঙ্গে রিভিউ দিলাম, কারণ সম্পূর্ণ আলাদা হয়েও বই দুটো কোথাও গিয়ে মিলে যায়, মানবসভ্যতার একটা সামগ্রিক বিশ্লেষণ যেমন পাবেন তেমনি শেষ করার পরে একটা হালকা মন খারাপের রেশ থেকে যাবে আপনার মনে , বিশেষত যখনই আপনি মরকত সবুজ, নীলকান্তমণির নীল আর মুক্তো সাদা রঙের আমাদের এই গ্রহটির ছবি দেখবেন।
Publisher: Patra Bharati- Rs.399
সে এক অদ্ভুত সময় বাংলাতে বুঝলেন। সময়কাল 700-750 CE, বাঙালির বড় দুর্দিন চলছে, মৎস্য মারিব খাইব সুখের সময় সে নয় , বরং মাছখোর বাঙালি ডুবে আছে মাৎস্যন্যায়ে। বড় বড় মাছ অর্থাৎ কিনা সামন্ত ভূস্বামীরা গিলে খাচ্ছে ছোট ছোট মাছ অর্থাৎ সাধারণ মানুষকে। কিন্তু এদেরও ওপরে আছে হাঙ্গর। এক নয় এক জোড়া ......
বিবেক - কিন্তু ভাই টেকনিক্যালি একটা তো হাঙ্গর নয় বরং ......
আমি - আচ্ছা আচ্ছা থামো তো বাপু, সেসব বলব।
তো সেই মাৎস্যন্যায়ে বাঙালির ভরসা এক মছলিবাবা। আরে থামুন তো মশাই, সবসময় রায় বাবুকে টানবেন না। ইনি হচ্ছেন মৎস্যেন্দ্রনাথ, যিনি কোনো ১০৮ বাবা ছিলেন না, তিনি লোকেশ্বর, মহাযোগী, পরম শৈব।
আর কে আছে জানেন ? পদ্মসম্ভব, আচার্য শান্তরক্ষিত, গোরক্ষনাথ, জালন্ধরী পা, কাহ্ন পা, জয়াপীড় এমন কি ভাঁড়ুদত্তও। একেবারে বঙ্গ-অন্ড!
বিবেক - বঙ্গান্ড ? উয়া কি বটেক ?
আমি - (ইংরেজিতে) ডাহা!!! বঙ্গ প্লাস ব্রহ্মাণ্ড। বঙ্গ-অন্ড। নাকি বঙ্গভার্স বলব ?
বিবেক - বাংলাভার্স ই বলো ভায়া।
ঠিক বাংলাভার্স। মানে বাঙালির মধ্যযুগে যা যা নাম আপনার মনে পড়বে, তারা সবাই, শর্ত একটাই পালবংশের প্রতিষ্ঠার আগে হতে হবে। এখন আপনি বলতে পারেন যে Gorakhnāth and the Kānphata Yogīs এ যেন এনাকে একাদশ শতাব্দীর বলা হয়েছে, তাহলে তাঁর গুরু অষ্টম শতাব্দীতে কি করে? দেখুন আমরা ইতিহাস বিস্মৃত জাতি, গোরক্ষনাথের গুরু মৎস্যেন্দ্রনাথ যে অষ্টম শতাব্দীর ও হতে পারে তা নিয়ে মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর জোরালো বক্তব্য আছে। আর সোজা কথা এটা ফিকশন এবং প্রথম বাংলাভার্স, অত খুঁত ধরার কিছু নেই।
তো গল্পের বিস্তৃতি বিশাল, সেই কলকেতা রানাঘাট তিব্বতের মতন। মানে তিব্বত, বঙ্গ, চীন মগধ প্রাগ্জ্যোতিষপুর , বিশাল ব্যাপার।
গল্পের শুরু তিব্বতে, এক স্পাই কেসে। তিব্বত রাজসভাতে ঝামেলা চলছে পোন ধর্মের অনুসারী অমাত্যদের সঙ্গে বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী তিব্বত সম্রাটের। পোনরা সাপোর্ট পাচ্ছে চীন থেকে , সম্রাটের ভরসা ভারতীয় বৌদ্ধরা। সেই সংঘাত নেমে এলো বাংলাতে। নানা ঝামেলার পরে রাজত্বের ভার এক রানীর হাতে। তবে আসল ক্ষমতা সচিব প্রকাশচন্দ্রের হাতে, যার আছে নানা অলৌকিক ক্ষমতা, যা সে পেয়েছে চীনের রানী যে আবার কিনা বিশাল তন্ত্র সাধিকা। আর বাংলার রানী ?? সে এক বিশাল ব্যাপার। সে মানুষ না। নাগিনী। কিন্তু তার মধ্যে আছে বাংলা এবং চীন, দুই রক্তধারাই।
কি করে ? কাট টু মহাভারত সময়কাল, পরীক্ষিত মারা গেছেন নাগদংশনে অর্থাৎ কিনা নাগবংশীয়দের আক্রমণে। জনমেজয় নাগ বংশীয়দের রাজধানী তক্ষশীলা আক্রমণ করে নাগদের প্রায় নির্বংশ করেছেন, আস্তিকের দৌলতে সম্পূর্ণ ধ্বংস হলোনা তারা। তবে ব্যথিত হৃদয় আস্তিক চলে গেলেন চীনে। তাকে চিনে নিলো চীনারা। এই বঙ্গরানীর জন্মধারা সেই আস্তিকের। তার দেহে বইছে আস্তিকের রক্তধারা।
বিবেক - কিন্তু ব্রো, তুমি এত রক্ত রক্ত কেন করছ? বঙ্গনাগিনীর দেহে তো রক্ত ছিল না।
আমি - (বিরক্ত হয়ে) এটাই তোর মাথায় এলো? আস্তিকের এই এক্সাইলে তো বাংলার কোনো হাত ছিল না, তাহলে তার বংশ এসে বাংলাতে বাশঁ কেন দিলো ?? হুঁ ?
বিবেক - কেন্দ্রের চক্কান্ত বলছ ?
আমি - অরে এটাকে নিয়ে তো পারা যায় না। কেন্দ্র কোথায় দেখলি ?
তো ফিরে আসি বাংলাতে, সিমসিম করছে রাত, নালন্দা মহাবিহারের এক কক্ষে এসে জমেছেন শান্তরক্ষিত, মৎস্যেন্দ্রনাথ, গোরক্ষনাথ, পদ্মসম্ভব , জালন্ধরপা, কাহ্নপা , ভিক্ষুনী মন্দর্ভ। মানে ভেবে দেখুন। বৌদ্ধ, শৈব এবং সহজিয়া , সব্বাই মিলেছেন একসঙ্গে। আর আছেন বপ্যট, ইনিই হচ্চেন গোপালদেবের পিতা।
এরপর ঘটে নানা ব্যাপার- গোপালদেব বঙ্গে প্রথম উচ্চারণ এবং পুজো করলেন দেবী দুর্গার। দেবী চন্ডী বাংলাভার্সে এলেন দুর্গা হয়ে। আলোচনার শেষে মৎস্যেন্দ্রনাথ বেরিয়ে পড়লেন পেপ টক দিতে যাতে বাংলার অন্য সামন্তরা যেন আসন্ন বিপ্লবের বিরোধিতা না করে। আজ্ঞে হ্যাঁ , বাঙালির বিপ্লববোধের সূচনাও এই বাংলাভার্সেই হয়। বাকিরা নেমে পড়লেন প্রকাশচন্দ্র, রানী এবং তাদের ছয় প্রধান সহযোগীদের নিকেশ করতে।
বিবেক - (ফিসফিস করে) আচ্ছা তখন বাংলাতে খড়গ বংশের কেন্দ্রীয় শাসন, আছে অনেক সামন্তও, তাহলে টেকনিক্যালি মাৎস্যন্যায় কি করে চলছে ? মানে আমআদমির ওপরে অত্যাচার তো সবাই করে।
আমি - করতে পারে , কিন্তু তা বলে প্রতি পনেরো দিন অন্তর রাণী একটা সা জোয়ান পুরুষকে ছিবড়ে করে দেবে ? থামো। ছিবড়েটা আমি দৈহিক নিষ্পেষণ এবং শেষে নিষ্কাশনের পরিপ্রেক্ষিতে বলেছি। আমি জানি শেষে রানী তাদের দংশন করতো। এটা কি ঠিক ?
বিবেক - কিন্তু ভেবে দেখো, ওই মাঝের পনেরো দিনে ওই অনিন্দ্যসুন্দরী রানী কিন্তু একেবারে নির্বিষ। সেটা তো .....
আমি - কি সেটা ? সেটা কি?
বিবেক - মুচকি হেসে - থাকগে ! তারপর কি হলো ?
তারপর অনেক কিছু হলো রে ভাই। প্রকাশচন্দ্রকে ক্ষমতাতে বসানো চারুদত্তকে দক্ষিণের এক অস্বাস্থ্যকর স্থানের কুটিরে বন্দি রাখা হয়েছিলাম কাহ্নপা ইত্যাদিরা গিয়ে তার পেট থেকে কথা উদ্ধার করে নিয়ে এলেন। কিন্তু এরপরে দরকার আছে রানীর মৃত্যু কি করে হবে সেটা জানা, সে আরেক রোমাঞ্চকর অভিযান, করলেন পদ্মসম্ভব , যিনি তখনো রিনপোচে হন নি তাই নানা দুষ্ট কার্য করতে বড়ই উৎসাহ পান। .... এটাই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ রানীই বঙ্গ, বঙ্গই রানী .... তার পদচটিকাতে। ....
বিবেক - ওয়ান মিনিট , ওয়ান মিনিট। তারমানে কি চারুদত্ত আদি গঙ্গার পাশের ওই খানে বন্দি ছিল? কুটির বললে, তারপর বঙ্গই রানী বলছ ?
আমি ( ব্যাকুল হয়ে ) - ওরে চুপ কর রে হতচ্ছাড়া, কে শুনে ফেলে চপ করে কেটে দেবে !!!
সে যাইহোক , প্রথম বিপ্লব ঘটলো মন্দিরে, এক পুজোতে এসেছে প্রকাশচন্দ্র থেকে রানী সবাই , মন্দির চত্বরে ভিড়। সেই ভিড় থেকে হঠাৎ কে উচ্চস্বরে গালি দিল শাসকদের, তারপর আরেকজন, তারপর আরেক জন, আস্তে আস্তে সব জনতা যেন খেপে উঠলো, ক্যা ক্যা ছি ছি রবে চাদ্দিক ভরে উঠলো, আর মন্দিরে দুম করে ফাটল পলিতা বোম-কন্দুক। সেই প্রথম বাংলাতে বোমা পড়া।
বিবেক - তার মানে তোমরা বেঙ্গলিরা বরাবরই ভুষুন্ডি টাইপের। পালবংশের প্রতিষ্ঠার সময়েই বোমা পড়ে যা চীনের থেকে আনা, অথচ কতগুলো পাল প্রজন্ম পরে তিব্বত আগত বিনয়ভদ্রের কাছে এই কন্দুক দেখে আশ্চর্য্য হয়ে গেছিলেন রাজপুত্র ও আচার্য অতীশ দীপঙ্কর ।
আমি - বিপ্লবীরা তখন কি পাসওয়ার্ড ব্যবহার করতো জানিস? কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল। চঞ্চল চীএ পইঠো কাল॥
বিবেকের ছোট ছোট খুঁচি খুঁচি চোখ গোল গোল হয়ে উঠলো।
কিন্তু আসল সমর হলো লালিম্বন পাহাড়ের নিচে শালিবন বিহারে। সেখানে মৎস্যেন্দ্রনাথ শালিধানের অন্নগ্রহন করছিলেন হয়তো ভর্জিত মৌরলা মাছ দিয়ে, কিন্তু খেতে দিলে না গা। প্রকাশচন্দ্র আক্রমণ করলেন। মৎস্যেন্দ্রনাথ, পদ্মসম্ভব, দেদ্দীদেবী, মন্দর্ভা, বপ্যট, এমনকি জয়াপীড় প্রবল রণে মত্ত হলেন। বৌদ্ধ ভিক্ষুকরাও পিছিয়ে রইলেন না, শৈব ত্রিশুল তুলে তারাও নেমে পড়লেন ফ্রন্টে। গোপালদেব তখন রাজপ্রাসাদে, রানীর মহড়া নিচ্ছেন, চীনাংশুকে আবৃত আলোছায়া ভর্তি ঘরে। মানে যুদ্ধ দুই ফ্রন্টে।
এখন আপনি ভাববেন, মৎস্যেন্দ্রনাথ এবং প্রকাশচন্দ্র, দুজনেই তন্ত্রে এত ক্ষমতাধারী, যুদ্ধে কি না কি হলো, এদের যৌগিক ক্ষমতার টক্করে অন্যরা হয়তো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। নাঃ। সে গুড়ে বালি। দুজনেই -
"রে রে পাষণ্ড দুরাচার
আজ বধিব তোরে
দিলি না খাইতে কুলের আচার "
- এই বলে হাতাহাতি তে মত্ত হলেন, এক পর্য্যায়ে প্রকাশচন্দ্র তো মৎস্যেন্দ্রনাথের চুলের মুঠি ধরে দিলেন আচ্ছা করে ঝাঁকিয়ে।
ওদিকে রাজপ্রসাদে গোপালদেব আচ্ছন্নতা থেকে জেগে উঠলেন, পাশে রানী হা ক্লান্ত হয়ে শুয়ে। আর উঠেই কিনা গোপালদেব বিকেলের দুধ চা না খেয়ে দিলেন গুলি করে।
ব্যাস। ওটাই ছিল প্রকাশচন্দ্রের লাস্ট হরক্রাক্স। আর লড়তে না পেরে ষাঁড়ের পিঠে চড়ে তিনি পগারপার।
তারপর আর কি ! আমার কথাটি ফুরোলো।
হ্যাঁ, আপনি ঠিকই ধরেছেন হরক্রাক্স বিদ্যা আমাদের ভেতর থেকেই পশ্চিমে যায়, কেন পড়েননি মাছের পেটে রাক্ষসের প্রাণ ? এখন ভোল্ডেমর্টই প্রকাশচন্দ্র কিনা আমি বলতে পারি না। আর হ্যাঁ , আরো কয়েক শতাব্দী পরে ভারতের দক্ষিণে রাজা কৃষ্ণদেব রায়ের রাজ্যে বলরাম কর্মকার যে তার স্পেশাল বিদ্যা নিয়ে গেছিলো তা এই গোপালদেবের থেকেই পাওয়া।
বিবেক - রানী তাহলে মরে গেলো ?
আমি - হ্যাঁ।
বিবেক- রানীর মুখে একটা তিল ছিল আর নাকটা একটু মিষ্টি মতন চাপা ছিল গো। কেন জানি মনে হলো এ কথাটা সবাইকে জানানো দরকার।
আমি - হতচ্ছাড়া। এই একটা গোটা উপন্যাস পড়ে তোর মনে শুধু এটুকুই লেগে থাকলো ?
কিন্তু ততক্ষনে ভোঁ করে বিবেক কোথায় যে চলে গেছে ।
তন্ত্রাভিলাষীর সাধুসঙ্গ- প্রমোদকুমার চট্টোপাধ্যায়
ডি এম লাইব্রেরি
দাম এখন কত জানা নেই।
প্রায় একশো বছর আগের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা এই বইটি একসময়ে বাঙালির ঘরে ঘরে থাকতো। সেই পুরোনো বইয়ের দাম আর উল্লেখ করলাম না, জানিনা, এখনো পাবলিশ হয় কিনা। বইটি অনেক আগে কিছু কিছু পড়েছিলাম। অভিজ্ঞতার সঙ্গে অনেক তত্ত্ব আছে বলে তখন আর পড়তে তেমন ভালো লাগে নি। কিছু দিন আগে আবার পড়লাম, সত্যি কথা বলতে কি তত্ত্বগুলো এবার ও যে খুব খুঁটিয়ে পড়েছি তা না, তবে অনেকটাই পড়েছি।
বইটা এবার পড়ার মূল কারণ ঐতিহাসিক ভাবে ১৯১০- ৪৭ সময়টা সম্পর্কে আরো কিছু জানার চেষ্টা , অভিজ্ঞতা গুলো সবই এই সময়কালের এমন নয়, পরের দিকেরও কিছু আছে, তবে সময়কাল গুলো আমি অন্তত সবসময় ঠাহর করতে পারিনি , বিশেষত দ্বিতীয় খন্ডের মাঝামাঝি থেকে তৃতীয় খন্ডের মধ্যে ঘটনাগুলির সময় অনেক আগে পিছে আছে বলে মনে হয়েছে।
এখন এই ঐতিহাসিকতার আগ্রহটা আমার মূলত দু ধরণের, প্রথম,তন্ত্রের আবির্ভাব নিয়ে, অনেক সাধুর মুখেই তত্ত্বালোচনা শুনতে গিয়ে লেখক সরাসরি এ কথা জিজ্ঞেস করেছেন, এবং উত্তর পেয়েছেন তন্ত্র বেদের থেকেও প্রাচীন। তাহলে তন্ত্রের মন্ত্রতন্ত্র সব সংস্কৃতে কি করে ? উত্তর বৈদিক ব্রাহ্মণরা তন্ত্রকে পছন্দ করেন নি হয়তো অনেকেই, কারণ তন্ত্র নারীপুরুষ, বর্ণভেদ ইত্যাদি দিয়ে কাউকে ফেরায় না, কিন্তু তা বলে তারা তন্ত্রের সাধন পথে যে সিদ্ধ হওয়াও যায় তা বুঝতে ভুল করেননি, তাই অনেক ব্রাহ্মণই এতে আকৃষ্ট হন। এবং এভাবেই শিব বৈদিক সমাজেও শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে ওঠেন, সম্ভবত তার আরেকটা কারণ শিব আয়ুর্বেদের ও জনক। হিমালয়ের বাইরে, অর্থাৎ কিনা হিমালয়ের বেশিরভাগটাই যে বৈদিক মুনিঋষিদের আশ্রয় ছিল তারও বাইরে কৈলাস অঞ্চলে তার আবাস এবং ওষধির শক্তির পরিচয় ও আদি বৈদিক সমাজ শিবের কাছ থেকেই পায়, এর পরেও আছে অস্ত্র। শিব অনেক দিব্যাস্ত্রের স্রষ্টা। এসব কারণেই তিনি কোনো সাধারণ দেব নন, মহাদেব। আর শিবই তন্ত্রশাস্ত্রের জনক তাতো আছেই। তাই হয়তো তন্ত্রের প্রথম আবির্ভাব তিব্বতেই হয়, সেখান থেকে ভারতে এবং চীন, এই দুদিকেই যায়। বৈদিক ঋষি বশিষ্ঠের চীনাচার তন্ত্রের সাধনও সেরকম ইঙ্গিত দেয়।
বাংলাতে তন্ত্রের প্রসারের কারণ বৌদ্ধ প্রভাব, আর হয়তো অ-বৈদিকম মানুষগুলির আগ্রহ। আর পতনের কারণ বৌদ্ধ ধর্মে অনাচারের প্রসার, যার জন্যে তন্ত্রের নামে যে কালিমা আসে তা আজও বিদ্যমান, আর শ্রী চৈতন্যের আবির্ভাব।
দ্বিতীয় হলো ওই সময়কালের বিখ্যাত তন্ত্রসাধকরা, শ্রীরামকৃষ্ণ এবং বামদেব। রামকৃষ্ণের সঙ্গে লেখকের দেখা হয়নি, সম্ভবত বিবেকানন্দের সঙ্গেও, তখন ও তিনি ছোট, কিন্তু বেলুড় মঠে তার যাতায়াত ছিল এবং শ্রীরামকৃষ্ণের সরাসরি শিষ্যদের সঙ্গেও জানাশোনা ছিল। এনাদের সম্পর্কে আমি আরো অনেক প্রত্যক্ষদর্শীর লেখা পড়েছি, কিন্তু ভেবে দেখলাম বামদেব বা বামাক্ষ্যাপার প্রত্যক্ষদর্শী কেউ কিছু লিখেছেন তা আমার এখনো পড়া হয়নি। তাই এই অংশটি আমার আগ্রহের ছিল, কিছুদিন লেখক ছিলেন এনার সঙ্গে। পরের বছরই বামাক্ষ্যাপা দেহত্যাগ করেন।
এমনিতে বইগুলিতে আপন তত্ত্বের সঙ্গে সঙ্গে অনেক অলৌকিক কাজ কারবারের বিবরণ ও পাবেন। সাধক ই বেশি, খুব অল্প সাধিকা। তার মধ্যেই কামাখ্যার এলোকেশীর কথা বিশেষ করে চোখে পড়ার মতন। সেটা শুধু সাধনার ব্যাপারেই নয়, তার চিন্তাভাবনার জন্যেই।
যেমন বলছিলাম, সেই সময়টা, ইংরেজ শাসন থেকে নোয়াখালীর দাঙ্গার মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতা এসব অল্পবিস্তর আছে, বাঙালি হিসেবে যেমন শ্রদ্ধার পাত্রও হয়েছেন তেমনই পুলিশের চোখে চোখেও থাকতে হয়েছে এই নবীন মুমুক্ষ কে। আর অবাক লাগে তারাপীঠ, বক্রেশ্বর কি অট্টহাসের মন্দিরগুলির এবং আশেপাশের কথা পড়ে, একশো বছর আগের সময় আর এখনকার সময়। তবে এসব আছে ছড়িয়েছিটিয়ে। আছে তখনকার সমাজের কিছু কথাও, লোকে যাত্রার সময়ে কিরকম ভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করতো তা পড়লে একটু অস্বস্তি হয়, আবার সাধু ভেবে সহায়তার কথাও আছে, ভন্ড সাধুদের নিয়ে বিরক্তিও।
তাই বলা যায় বইগুলি নানা কারণেই পড়া যায়, ধর্ম, দর্শন কি পুরোনো সময়কে ফিরে দেখা।
অনেক দিন ধরে একটা বই বা সিরিজ পড়তে থাকলে আর সেটা শেষ হয়ে গেলে বেশ ফাঁকা লাগে। এখন আমার এই অবস্থা। লেখক Glyn Iliffe. ছয় খন্ডে ইলিয়াড ওডিসির ফিকশন লিখেছেন, অর্থাৎ কিনা বিনির্মাণ। পড়ছিলাম সেটাই, প্রায় ছয়মাস ধরে। লেখক বলেছেন এই সিরিজ লিখতে তার সময় লেগেছে আঠেরো বছরের মতন, যার অর্ধেকটাই প্রিপারেশন নেওয়া।
তবে বিনির্মাণ হলেও তিনি মূলগল্পে বা মূল ঘটনাগুলোতে হাত লাগাননি, একটা দুটো নতুন ক্যারেক্টার এনেছেন যা গল্পকে বদলায় না , কোনো ছোট চরিত্রকে একটু বড় রোল দিয়েছেন , এরকম সব। আর সবথেকে বড় কথা কোথায় কি পরিবর্তন করেছেন তা খুব পরিষ্কার করে বইগুলোর শেষে বলে দিয়েছেন। সেগুলো থেকে বোঝা যায় তিনি আসলে খাবারে মসলা যোগ করেননি, পরিবেশনের কায়দা পরিবর্তন করেছেন।
ওডিসিও মূলত একটা যুদ্ধের কাহিনী, মহাভারতে যেমন কুরুক্ষেত্র সবকিছুর কেন্দ্রে থাকে তেমনই ওডিসিতে থাকে ট্রয়। এবার এরকম যুদ্ধের কাহিনী পড়লেই আমাদের মহাভারতের কথা মনে না এসে উপায় নেই, মজার কথা হচ্ছে এই দুই মহাকাব্যের মধ্যে কিন্তু কিছু কিছু সাযুজ্য আছে। মানে দ্রৌপদী -হেলেন, ট্রয় - কুরুক্ষেত্র এসব কে বাদ দিলেও আরো বেশ কিছু মিল পাওয়া যায়। মহাকাব্যিক চরিত্র, দেবতাদের নানা প্যাঁচ কষা এসব। প্যারিসের পিতা ট্রয়ের রাজা প্রিয়াম তো এক্কেবারে ধৃতরাষ্ট্র। প্যারিসের জন্মলগ্নেই দৈববাণী হয় এই ছেলে ট্রয়ের দুর্দশার কারণ হবে। তাও সে ছেলেকে ছাড়তে পারে না, আর একশো না হলেও প্রিয়ামের পঞ্চাশটা ছেলে ছিল। একিলিসের- অর্জুন , হেক্টর কর্ণ, এজাক্স ভীম, এসব কিছুটা চারিত্রিক বৈশিষ্টের জন্যেই মিল, আর কিছু না।
কিন্তু দুই মহাকাব্যের মধ্যে অমিলই বেশি। মহাভারতের মতন ডেপথ মূল ইলিয়াড ওডিসিতে আছে কিনা জানি না, তবে এই ছয় খন্ডের বিনির্মাণ যে মহাভারতের বিশালত্বের তুলনীয় তা বলতে পারি। ওডিসিউস থেকে হেলেন, নানা চরিত্রের বিস্তার এই বইগুলিতে দারুন। যেমন সিরিজের নাম, সেরকমই গল্প আবর্তিত হয়েছে ওডিসিউস কে নিয়ে, প্রাচীন গ্রিসের একপ্রান্তের এক তুচ্ছ রাজ্য ইথাকার রাজপুত্র হিসেবে যে এডভেঞ্চারের শুরু তা আবার শেষ হয় ট্রয় যুদ্ধের শেষে তার ইথাকাতে প্রত্যাবর্তনের মধ্যে। মাঝে কেটে যায় ত্রিশ বছর। ছটি বই এই সময়কালের, আর যেহেতু এই জার্নি ডেলফির মন্দির হয়ে স্পার্টার হেলেন থেকে ট্রয় হয়ে আরো বহু বহু ফ্যান্টাস্টিক জায়গার মধ্যে দিয়ে তাই ফ্যান্টাসির পাঠকের জন্যে তা বড় লোভনীয়। কিন্তু এই বিরাট সিরিজে ফ্যান্টাসিই প্রধান নয়। এইটা প্রধানত মহাকাব্যিক চরিত্রগুলোর আরো বিস্তার করা প্রেম, বন্ধুত্ব, ইগো, দুঃখ, নির্মমতা, শঠতা, সবমিলিয়ে এক বহুমাত্রিক বহুচারিত্রিক কাহিনী।
হেলেন, পেনেলোপি, আগামেমনন, মেনেলাউস, এজাক্স, একিলিস, সার্সি, ক্যালিপসো এর সাথে আছে গ্রিক দেবতারা, এথেনা, হার্মিস, পোসাইডন।
এই মহাকাব্যিক চরিত্রগুলো একসময়ে তরুণ ছিল, তখন তারা ভাবতো পৃথিবী তাদের পায়ের তলায়। সমস্ত গ্রিক রাজারা মিলে যেদিন ট্রয়ের বিরুদ্ধে যাত্রা করে তারা ভাবেনি সে যুদ্ধ দশ বছর স্থায়ী হবে। এই যুদ্ধ বদলে দিয়েছিলো সবাইকে।
আর ওডিসিতে যেটা বিস্মিত করে তা হলো গ্রিক দেবতাদের চরিত্রায়ন। তারা ঠিক আমাদের ভারতীয় দেবতাদের মতন নন, তারা অনেক বেশি কুটিল, হিংসুক, নির্মম, এবং আধিপত্যকামী, মানুষ তাদের ভজনা না করলে তাদের চলেনা, কিন্তু সেই মানুষই তাদের খেলার প্রধান সামগ্রী। দেবতা আর মানুষের মধ্যে ভক্তিশ্রদ্ধার সম্পর্ক নেই, আছে ভয়ের সম্পর্ক।
তাই বারবারই সেই দেবতারা আসেন পৃথিবীতে, খেলার দান দিতে। প্রফেসির মাধ্যমে তাঁরা জানিয়ে দেন ভবিষ্যৎ , যেন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়া, হে মরণশীল তুচ্ছ মানুষ, আমি এটা স্থির করেছি, এটাই হবে, পারো তো পরিবর্তন করো। মানুষকে জানিয়ে দেন তোমার মৃত্যু হবে ট্রয়ে গেলে, কিন্তু সে না গিয়েও থাকতে পারে না। ওডিসিয়ুস কে ছোটবেলা থেকে এথেনা বাঁচান নানা বিপদাপদের হাত থেকে, সে যে করুণা ছিল না , সে কথা ওডিসিয়ুস বোঝে পরে, যে এক ক্রীড়নক মাত্র , কিন্তু তার কিছুরই করার থাকে না। আর গ্রিকদের ছিল না পুনর্জন্মের আশাও, তারা জানে মৃত্যুর পরে হার্মিস আসবেন তাদের আত্মাকে নিয়ে যেতে, আর সেই আত্মা হেডিসের রাজত্বে থাকবে কল্প জুড়ে। মৃত্যুতেও নেই কোনো মুক্তি, তাই তাদের একমাত্র কামনা তাদের মৃত্যুর পরে যেন কেউ তাদের নামটুকু অন্তত মনে রাখে , তার উপায় একটাই, বীরত্ত্ব দেখানো। তার মৃত্যু হলে ট্রয়ের ও পতন ঘটবে একথা জেনেও হেক্টর তাই মুখোমুখি হয় একিলিসের। ট্রয়েই তার মৃত্যু সে কথা জেনেও একিলিস আসে সেখানে, দশবছর ধরে অক্লান্ত বীরত্ব দেখিয়েও মৃত্যুমুহূর্তে তার মনে সংশয় আসে, মানুষ তাকে মনে রাখবে তো?
কিন্তু দশ বছরের যুদ্ধের পরে? যারা বেঁচে থাকে তাদের কি আর বীরত্বের স্পৃহা থাকে? যে রাতে ট্রয়ের পতন হলো সে রাত আসলে কি গ্রিসের বিজয় ছিল ? রাজাদের দশ বছরের অনুপস্থিতি মূল গ্রিসের জনগণের ওপরে কি ইফেক্ট ফেলেছিল ? এই সব জিনিস ও লেখকের ভাবনা থেকে বাদ পড়ে নি। ওডিসিউস চায় যত তাড়াতাড়ি পারে তার ছোট্ট রাজ্যে ফিরতে, সেখানে দশ বছর আগে সে আর সদ্যজাত ছেলে আর বৌকে রেখে এসেছে যে। কিন্তু দেবতারা কি তা চান ? শুরু হয় ভয়েজ অফ ওডিসিউস, সাইক্লপ্স থেকে নিমফ, কাদের পাল্লায় না পড়তে হয় তাকে। কিন্তু হেলেন? সে কি চায় মেনেলাউসের সাথে স্পার্টাতে ফিরতে ? এত যুদ্ধ, লোকক্ষয় সবকিছুর অর্থ তাহলে কি?
আর দশ বছরের যুদ্ধের শেষে যারা মারা যায়? মহাভারতের মতন তাদের স্বর্গবাস হয়না, অলিম্পিয়াসে কেবল দেবতারাই থাকতে পারে। বাকিরা যায় হেডিসের মৃত্যু উপত্যকাতে। সশরীরে স্বর্গ যাত্রা হয়না ওডিসিউসের, তাকে ঘুরে আসতে হয় নরক। সেখানে কি দেখে সে ? মৃত্যুর পরে আসলে নেই কোনো আশা। একিলিসের আত্মা তাকে বলে যায় আসল কথাটি। বেঁচে থাকো বন্ধু, যতদিন বেঁচে আছো ততোদিন জীবনকে আঁকড়ে ধরে উপভোগ করো। কারণ তারপরে আর কিছুই নেই।
এখানেই ওডিসি মহাকাব্যিক হয়ে যায়, যুদ্ধবিগ্রহ আসলে মানুষের জীবনের কেন্দ্র না, যশোলাভ ও না। বরং বেঁচে থাকাটা উপভোগ করাটাই আসল। আসলেই মহাভারত বা ওডিসি, কোনো মহাকাব্যই আমাদের শান্তি দেয় না , স্বস্তি দেয় না।
এই বইগুলোতে লেখক সেটাকেই অতি সুন্দর ভাবে বর্ধিত করেছেন, বিনির্মাণ করেছেন, মূল ঘটনাগুলি এবং বার্তাটুকুকে অক্ষত রেখে। তাই প্রথম বইয়ের ডেলফির ওরাকলদের ভবিষ্যৎবাণী শুনতে আসা তারুণ্যে ভরপুর ওডিসিউস যখন আর শেষ বইয়ের মধ্যবয়স্ক এক সর্বহারা মানুষের রূপে ইথাকাতে এসে পৌঁছয়, তখন মাঝের ত্রিশ বছরের অর্থহীন সময়যাপন পাঠক হিসেবে আপনাকে হন্ট করে। আর তখনো ওডিসিউসের পরীক্ষা শেষ হয় না, তাকে তখনো এক দৈবী ধনুকে জ্যা পরাতে হবে আর লক্ষভেদ করতে হবে, যেন হরধনুতে জ্যা রোপন আর অর্জুনের লক্ষভেদ।
Adventures of Odysseus, A series by Glyn Iliffe
কিন্ডলে দাম গড়ে ২৫০/৩০০ টাকা করে।
1. King of Ithaca (2008)
2. The Gates of Troy (2009)
3. The Armour of Achilles (2010)
4. The Oracles of Troy (2014)
5. The Voyage of Odysseus (2016)
6. Return to Ithaca (2017
The Kaoboys of R&AW: Down Memory Lane-B. Raman
Publisher : Lancer Publishers LLC, Kindle Edition : ₹587.05
আমাদের দেশের গোয়েন্দা ইতিহাস নিয়ে বিশেষ কিছু পাওয়া যায় না। কেন পাওয়া যায় না তা লেখক এই বইয়েই বিশ্লেষণ করেছেন। সাধারণ ভাবেই গোয়েন্দাগিরিতে গোপনীয়তাই সর্বোচ্চ স্থান পায়। গোয়েন্দাকর্তারা এমন কি অবসরের পরেও তা নিয়ে কিছু বলতে প্রায় আঁতকে ওঠেন, তাদের ভয় থাকে যে মুখ ফস্কে কিছু বেরিয়ে গেলে দেশের ক্ষতি হবে কিনা, আর গুপ্তচরের ক্ষেত্রে তো আরো মুখে কুলুপ। সিআইএ সম্ভবত একমাত্র সংস্থা যা এ ব্যাপারে সরকারি ভাবে কিছু নীতি প্রণয়ন করেছে। সেখানে গোয়েন্দাকর্তারা অফিসিয়ালি তাদের অভিজ্ঞতা রেকর্ড করে রাখতে পারেন। এসব সংস্থার অপারেশনাল বা অন্যান্য ফাইলের বাইরের জিনিস। গোয়েন্দাদের জীবনভর অভিজ্ঞতার একটা রেকর্ড থাকলে তা পরবর্তীকালেও অনেক কাজে আসতে পারে।
রমন বলেছেন যে র এর প্রতিষ্ঠাতা কাও অনেকগুলি ক্যাসেটে তার অভিজ্ঞতা রেকর্ড করেছেন, এমনকি তিনি নিজেও অনেক কিছু অবসরের পরে পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু তার কি হলো জানেন না।
শুরুতেই এই কথা বললাম, কারণ র এর মতন সংস্থার একজনের নিজের অভিজ্ঞতা লেখার কথা শুনে হয়তো অনেকে ভ্রু কুঁচকাবে। তবে আমার মনে হয় এরকম একটা বইয়ের অবশ্যই দরকার ছিল। যদিও এতে একেবারে শুরুর দিকের কথা নেই, কিন্তু রমন ১৯৬৮ থেকে র সঙ্গে, প্রায় জন্মলগ্ন থেকে। ১৯৬৮ থেকে শুরু করে মুম্বাই বিস্ফোরণ, মোটামুটি এই সময়কালের কথাই এই বইতে আছে।
১৯৬৮, কি তার কিছু আগে থেকে ভারতে কি কি ঘটেছে তা ভাবলে এখন মাঝে মাঝে মনে হয় দেশটা যে টিকে গেলো এসবের পরেও তার কারণ নিশ্চয়ই অনেক অনেক অজানা দেশভক্ত, পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ, চীনের সঙ্গে যুদ্ধ, উত্তর পূর্ব ভারতের জঙ্গীরা, কাশ্মীরী জঙ্গিরা, খালিস্তান, নকশাল, এলটিটিই , আমেরিকার নানা বদমাইশি।
রমন কাজ শুরু করার সময়ে র এর সামনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মিজো জঙ্গিদের উপদ্রব। মনে রাখতে হবে তখন আইবি ভেঙে ইন্দিরা গান্ধী সবে র তৈরী করেছেন, আইবির লোকেরা খুশি না, পররাষ্ট্র দপ্তর তো বরাবরই বিরোধী। তা সত্ত্বেও র এই দুই ক্ষেত্রেই ভালো সাফল্য পায়। রমন সোজাসুজি বলেছেন বাংলাদেশের যুদ্ধে র এর সাফল্যের কারণ দুটো, এক পাকিস্তানে এবং বিদেশের নানা দূতাবাসে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের আমলাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি করা, যাতে তারা তথ্য যোগান এবং পাকিস্তনের সামরিক বাহিনীর সম্পূর্ণ বেকুবের মতন রেডিও যোগাযোগ করা।
কিন্তু জলদিই র সিআইএ এবং চীন সিক্রেট সার্ভিসের এবং দেশের ভেতরেও নানা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়, খালিস্তান, কাশ্মীর। আর ভারতের রাজনৈতিক গোলযোগ। ইন্দিরা থেকে অটলবিহারীর মধ্যে মোরারজি, গুজরাল, রাজীব, ভিপি সিং, চন্দ্রশেখর, নরসিম্হা রাও, দেশের নানা প্রধানমন্ত্রীর র সম্পর্কে ধারণা এবং সহযোগিতার নানা উত্থানপতন ছিল। মোরারজি তো প্রায় গোয়েন্দা সার্ভিস বন্ধই করে দিচ্ছিলেন, আবার আশ্চর্যজনক ভাবে তুলনামূলক নড়বড়ে রাজনৈতিক অবস্থানে থাকা চন্দ্রশেখরের র এবং অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থাকে হ্যান্ডল করা দেখে রমন অবাক হয়েছিলেন।
বইটিতে আছে নানা আমলাতান্ত্রিক, ডিপার্টমেন্টাল এবং অফিসারদের কীর্তির কথা। জেনেভাতে রমন ভারতীয় দূতাবাসে কাজ করতেন, র এর পরিচয় লুকিয়ে, কিন্তু একদিন এক পার্টিতে এক উচ্চপদস্থ অফিসারের মদালসা স্ত্রী সবাই কে ডেকে ডেকে একজন লুকিয়ে থাকা গোয়েন্দার সাথে সবাইকে পরিচয় করিয়ে দেন , তিনি হচ্ছে রমন।
রমন লুকোননি র এর ব্যর্থতার কথাও, রাজীব গান্ধী কে হত্যা, মুম্বাই বিস্ফোরণের আন্দাজ না পাওয়া, কারগিলের সার্বিক ইন্টেলিজেন্স ব্যর্থতা। আর আমাদের নানা প্রধানমন্ত্রী থেকে মুখ্যমন্ত্রীদের নানা বোকামির কথা, যার ফলে হয়ত বা প্রাণ যায় অনেক গুপ্তচরের।
কিন্তু বইটা পড়ে আমার মনে হয়েছে ভারত চীন নিয়ে কখনোই তেমন করে কিছু ভাবে নি। পাকিস্তান আর দেশের ভেতরের বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিগুলোর মোকাবিলা করতে করতেই আমাদের বেশিভাগ সময় গেছে, এর পেছনেও যে চীনের হাত আছে তা নিশ্চিত। রমন র আর চীন নিয়ে তেমন কিছুই বলেননি, হয়তো কৌশলগত কারণেই বলেননি।
তবে ভেবে দেখলে শেষের পঁচাত্তর বছরে এই দেশটাকে যা যা কিছুর সামনাসামনি করতে হয়েছে সেসব ভাবলে র এর সাফল্যের ভাগই বেশি বলে মনে হয়। আরেকটা ইন্টারেষ্টিং জিনিস আমার মনে হয়েছে, র এর জন্মের সময়ে ভারতে গোয়েন্দা সংস্থা ছিল মূলত তিনটি, তাতেই গোয়েন্দা তথ্যের বিনিময় তেমন হতো না , রমন রিটায়ার করার সময়ে তা বেড়ে হয়েছিল আট, আর তারপরেও NIA এর জন্ম হয়। এখন এই এতগুলো সংস্থার মধ্যে সম্পর্ক রাখা আরো হয়তো সমস্যার। হয়তো না , কোনো কার্যকর মেকানিজম তৈরী হয়েছে, সে সব হয়তো জানা যাবে আরো কয়েক দশক পরে।
William Dalrymple
ইবুক: ₹267
এই বইটা সম্পর্কে কি লিখবো অনেকদিন ধরে ভাবছিলাম, এটা পড়া একটা অভিজ্ঞতা। আমরা ভারতীয়রা খানিকটা অতীতে বাঁচি, আমাদের যা বর্ণময় অতীত তাতে সেটা আশ্চর্যের কিছু না, বর্তমান কাল থেকে আমাদের মন সেই পৌরাণিক কালে পৌঁছে যায় নিমিষেই। এবার দিল্লির মতন একটা জায়গার কথা যদি ভাবেন, যেখানে ভারত ইতিহাসের অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ , ইতিহাস রচনাকারী ঘটনা ঘটেছে, সেখানে একটা বিপরীত কালানুক্রমিক যাত্রা আমাদের কাছে কি ভীষণ আকর্ষণীয় হতে পারে?
এই আশা নিয়েই এই বইটা পড়া, এই বিপরীত কালানুক্রমিক যাত্রার শুরু গতশতাব্দীর আটের দশকের শেষে, তখন শিখ দাঙ্গাসদ্য অতীত, সেই সময়ে ব্রিটিশ ডালরিম্পল ভারতে এলেন। বইটা আসলে তার ভারতবাসের শুরুর দিকের অভিজ্ঞতা আর দিল্লিকে আবিষ্কারের কথা।
দিল্লিকে আবিষ্কার কি করে করবেন? নাকি হাজার হাজার বছর ধরে দিল্লি গড়ে উঠেছে স্তরে স্তরে, একটার ওপরে আরেকটা , স্বাধীন ভারত, ইস্ট ইন্ডিয়ার ভারত, ব্রিটিশ ভারত, মুঘল যুগ, পাঠান যুগ, হিন্দু রাজাদের যুগ হয়ে মহাভারতের ইন্দ্রপ্রস্থ...... সব তো ঢাকা পড়ে যায় একেঅপরের নিচে।
এই বর্ণনা সরস, কিন্তু তা আপনাকে অনেককিছুর মুখোমুখি করিয়ে দেবে, যার সবটাই স্মৃতিকাতরতা নয়, বস্তুত সারা বইটা জুড়ে আপনাকে খানিকটা টাইম মেশিনের যাত্রার স্বাদ দেবে।
তবে সব যুগ সম্পর্কে বিশদে বলা নেই , মূলত কোম্পানির ভারত আর মুঘলযুগ বিস্তারিত, কারণ বোঝা যায়, তার পরে বইগুলোর কথা মনে করলে, পাঠান যুগ সম্বন্ধে কয়েক প্যারা থাকলেও আগের হিন্দু যুগ নিয়ে কিছুই নেই, ইনি ইতিহাসনিষ্ঠ তাই নিজে যাচাই না করে লিখবেন না তা অনুমান করা যায়, আর সে যাচাই করার সময় তার তখন হয় নি।
কিন্তু বইটার অমোঘ আকর্ষণ তার অভিজ্ঞতা, ১৯৮০ এর দশক মানে ভারত স্বাধীন সবে চারদশক। একটা ন্যুব্জ দেশ, প্রানপনে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, ভেতরের নানা ঝামেলার জন্যে প্রায় হাঁটুগেড়ে বসার অবস্থা সে দেশের। তখনকার জনগণের সদ্য চলে যাওয়া ব্রিটিশ প্রভুদের স্মৃতি কতটা মনে আছে?
ভারতে আসার আগে ডালরিম্পল ব্রিটেনের নানা লোকের সঙ্গে দেখা করেছেন, যারা ইন্ডিয়াতে জীবনের কিছুটা অংশ কাটিয়েছেন। বা তাদের পরিবারের কেউ কাটিয়েছে। কেমন ভাবে বাস করছেন তারা? অতীতের ঘিয়ের গন্ধের কথা মনে করে করে। ইন্ডিয়ার স্মৃতি দারুন স্ট্রং তাদের মনে, দিল্লির স্মৃতি, সিমলার স্মৃতি, ঘোড়া চড়া, শিকার করা, সন্ধের পার্টি, সদ্য যুবক-যুবতীদের চোখাচুখি হওয়া, আহা সে কি জীবন ছিল কালিদা !!!
তো ডালরিম্পলের ধারণা ছিল ভারতীয়রাও সেরকমই যাকে ইংলিশে বলে fondly ব্রিটিশদের কথা মনে করবেন, অন্তত দিল্লিতে, সেখানে ক্ষমতার ভরকেন্দ্র তো লুটিয়েনের প্রাসাদে।
কি দেখলেন তিনি? একটা ঘটনার বর্ণনাই যথেষ্ট, দিল্লির কেন্দ্রে ব্রিটিশ রাজা জর্জের মূর্তি ছিল, সেই মূর্তি আর ডালরিম্পল খুঁজে পান না, শেষে পেলেন, দিল্লির সীমানাতে ফাঁকা মাঠের এককোনাতে সেই মূর্তি এখন স্থাপিত, কাছে যেতে হলে জলকাদা মাড়িয়ে যেতে হবে।
তিনি বুঝলেন ভারত তার উপনিবেশ অতীত নিয়ে ভাবিত না। তিনি নিজে ব্রিটিশ, কিন্তু ইংলিশ নন, স্কটিশ, যা তাঁর মতে তাকে নির্মোহ ভাবে এই পরিবর্তন বুঝতে সাহায্য করেছিল।
কিন্তু এখনো আরেকদল লোকের খোঁজ বারকরা বাকি ছিল। Anglo Indian রা। এরা বরাবরই ছিলেন না ঘরকা না ঘাটকা, সেই সতেরোশো থেকেই। ব্রিটিশ আমলে এদের বাপ পিসে মাসি খুড়ো সবাই রেলে বা টেলিগ্রাফে চাকরি করতো, স্বাধীনতার পর সে সুযোগ গেলো , তরুণরা ভারত ছাড়লো, কোথায় গেলো? ব্রিটেন তাদের নাগরিক বলে স্বীকার করেনি, এমনকি ভিজিটর ভিসাও দেয় নি. এদের যেতে হয়েছিল অস্ট্রেলিয়া বা কানাডাতে।
কিন্তু যে বুড়োবুড়িগুলো যেতে পারলেন না? তাদের জীবনযাত্রা কোথায় যেন এক হয়ে যায় মুঘল যুগের আমির ওমরাহদের বংশধরদের সঙ্গে, হয়ত বা শতকের ব্যবধানে। সাম্রাজ্যের পতনেরএরা সব কোল্যাটারাল ড্যামেজ।
এটাই আমার কাছে মূল নির্যাস বইটির
ইতিহাসের ক্ষেত্রে ছোটবেলাতে সাম্রাজ্যের সূচনা আর রাজাদের ক্ষমতায় উত্থানের গল্প পড়তে ভাল লাগতো, এখন সাম্রাজ্যের পতনের কারণ জানতে ইচ্ছে করে আর জানতে ইচ্ছে করে শেষ রাজার কথা। যারা যুদ্ধে মারা গেলেন তাদের কথা আলাদা, কিন্তু যাদের বেঁচে থেকে ক্ষমতা ত্যাগ করে শেষে ইতিহাসের গর্ভে বিলীন হয়ে যেতে হয়, তাদের কথা জানতে ইচ্ছে করে ।
যেমন রাশিয়ার শেষতম জার, সোভিয়েত দেশে কমুনিষ্ট শাসন কায়েম হবার সময়ে তার পরিণতি করুণ। আর কিছুদিন আগে চোখে পড়ল আরেকজনের কথা। পুই,যিনি হেনরি পুই নামেও পরিচিত, তিনি ছিলেন চীনের শেষ সম্রাট এবং তাঁর জীবন ছিল নাটকীয় পরিবর্তন এবং ঐতিহাসিক তাত্পর্যে ভরা। এখানেও জড়িত ছিল সোভিয়েত দেশ, এবং চীনের কমুনিষ্ট শাসন।
পুই 7 ফেব্রুয়ারি, 1906, চীনের বেইজিংয়ে জন্মগ্রহণ করেন। আগের গুয়াংজু সম্রাট ছিলেন তাঁর কাকা, তার মৃত্যুর পর তিনি 1908 সালে দুই বছর বয়সে সিংহাসনে আরোহণ করেন। সম্রাট হিসাবে তার শাসনকাল অতি স্বল্পস্থায়ী ছিল, কারণ তিনি 1912 সালে সাংহাই বিপ্লবের কারণে সিংহাসন ত্যাগ করতে বাধ্য হন, অবসান হয় 2,000 বছরেরও বেশি সময় ধরে টিকে থাকা চৈনিক রাজতন্ত্রের।
পদত্যাগের পরবর্তী এক যুগ পুই 1924 সাল পর্যন্ত নিষিদ্ধ শহরেই (Forbidden City) বাস করেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেখান থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয় এবং তিনি তিয়ানজিন শহরে জাপানি কনসেশনে আশ্রয় প্রার্থনা করলে তা মঞ্জুর করা হয়, তত্কালীন চীনে তাঁর আর কোন থাকার জায়গা ছিল বলে মনেও হয়না। আপাততভাবে পুই তিয়ানজিনে জাপানি কনসেশনে ভালই ছিলেন, তার সম্পদও তিনি খানিকটা ধরে রাখতে পেরেছিলেন এবং জাপানিদের কাছ থেকে আর্থিক সহায়তাও পেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি সম্ভবত জানতেন না যে তত্কালীন যুদ্ধবাজ জাপানিরা,যাদের চীন আক্রমণের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল, তিনি তাঁদের পাল্লায় পড়েছেন। এরা পুইকে একটি কৌশলগত ভাবে দরকারী ব্যক্তি হিসাবে দেখেছিলেন।
1932 সালে, মাঞ্চুরিয়াতে জাপানি আক্রমণের পরে, পুইকে মাঞ্চুরিয়ার প্রধান হিসাবে ঘোষণা করা হয় এবং 1934 সালে, তাকে চীনের সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করা হয়। মাঞ্চুরিয়াতে তার শাসন মূলত প্রতীকী ছিল, জাপানী অধিকৃত অঞ্চলের বাইরে তার কোন ক্ষমতা ছিলনা, আর আসলে তিনি 1945 সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্যন্ত জাপানিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত পুতুল রাজা ছিলেন। যুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের পরে তাঁর জীবনে আবার দুর্যোগ নেমে আসে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পুই সোভিয়েত বাহিনীর হাতে বন্দী হন এবং 1950 সাল পর্যন্ত বন্দী হিসেবে থাকেন, ওই বছর যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচারের মুখোমুখি হবার তাকে জন্য বেইজিংয়ে প্রত্যাবর্তন করান হয়। 1959 সালে তাকে ক্ষমা করা হয়েছিল, কিন্তু মাঝের চার বছরে তাকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়, যাকে বলা হত রি এডুকেশন, মাও এর নয়া সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অনুমোদিত শিক্ষা আর কি।
পরবর্তী বছরগুলি তিনি বেইজিংয়ে কাটিয়েছেন নানা ছোটখাট কাজ করে, কখনো রাস্তা সাফাই কর্মী, কখনো মালী এবং আরও নানা কাজ।
সম্রাট থেকে সাফাই কর্মিতে পরিবর্তন যদি আপনার ট্রাজেডি বলে মনে হয়, তবে সম্রাজ্ঞীর কথাও একটু জানা দরকার। পুইয়ের প্রথম স্ত্রী ছিলেন ওয়ানরং, যিনি সম্রাজ্ঞী জিয়াওকেমিন নামেও পরিচিত। তাদের বিয়ে হয় 1922 সালে, যখন পুই নিষিদ্ধ শহরে বন্দীই ছিলেন বলা যায় । ওয়ানরং ছিলেন সম্ভ্রান্ত মাঞ্চু পরিবাবের মেয়ে এবং তিনি উচ্চশিক্ষিত ছিলেন, বস্তুত শিক্ষার কারণেই তিনি পুইয়ের স্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। জাঁকজমক সত্ত্বেও এই বিয়ে নিয়ে ওয়ানরং খুশি ছিলেন না, কারণ পুইয়ের বস্তুত বংশগত কৌলিন্য ছাড়া আর কিছুই ছিল না । পরবর্তীকালে পুই এর জীবনের ওঠা নামা এবং তাদের ঘিরে থাকা রাজনৈতিক অস্থিরতার সাথে ওয়ানরং লড়াই করেছিলেন কিন্তু সামলাতে পারেননি। তিনি আফিম আসক্ত হয়ে পড়েন যা সময়ের সাথে সাথে আরও খারাপ হতে থাকে। জাপানি দখলের সময় তিনিও সম্রাজ্ঞী হয়েছিলেন, কিন্তু তার জীবন ব্যক্তিগত কষ্টে ভরা ছিল। যুদ্ধের শেষে, 1945 সালে চীনা কমিউনিস্ট বাহিনীর হাতে তিনিও বন্দী হন, তাকে জিলিন প্রদেশের একটি কারাগারে রাখা হয়েছিল এবং 1946 সালে কারাগারেই তিনি মারা যান। বলা হয় এই সময়টুকু আফিম না পাবার জন্যে উইথড্রয়াল সিনড্রোমে বহু কষ্ট পেয়েই তিনি মারা যান। উচচ শিক্ষিত মেয়েটির জীবন অন্য খাতে বইতেই পারত, যদি এই বিয়ে না হত।
পরে পুই ওয়েনসিউকেও বিয়ে করেছিলেন, তবে তাদের বিয়ে টেকেনি, ওয়েনসিউ 1931 সালে পুইকে ছেড়ে চলে যান, তিনি বিবাহবিচ্ছেদ চেয়েছিলেন, যা সেই সময়ে অত্যন্ত অস্বাভাবিক এবং কলঙ্কজনক ছিল। পরবর্তী জীবনে, পুই 1962 সালে লি শুক্সিয়ান নামে একজন নার্সকে বিয়ে করেছিলেন। 1967 সালে মৃত্যু পর্যন্ত, লি শুক্সিয়ান পুইয়ের শেষ বছরগুলিতে তাকে সাহচর্য এবং যত্ন প্রদান করেছিলেন।
পুইয়ের ব্যক্তিগত জীবন, মানুষের ভাগ্যের নাটকীয় উত্থান পতন এবং বিংশ শতাব্দীতে চীনা সমাজে আমূল পরিবর্তনকে প্রতিফলিত করে। তার আত্মজীবনী, “From Emperor to Citizen” 1964 সালে প্রকাশিত হয়েছিল। পুই 17 অক্টোবর, 1967-এ বেইজিং -এ মারা যান। 1987 সালের "দ্য লাস্ট এম্পারার" চলচ্চিত্রে তার জীবন কাহিনী চিত্রিত হয়েছিল, যা বেশ কয়েকটি একাডেমি পুরস্কার জিতেছিল।